দেবদূত ঘোষঠাকুর
লন্ডনে ভাস্কর্যের এক প্রদর্শনী যাওয়ার সুযোগ পেলেন কলকাতার এক তরুণ মৃৎ শিল্পী। তাঁর কাজ দেখে খুশি হয়ে শিল্পীকে লন্ডনে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের তৎকালীন (১৯২৪) অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউন। ব্রিটিশ সরকারের অতিথি হিসেবে লন্ডনে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠলেন ওই যুবক। সঙ্গে তিনটি ব্যারেলে মাটি। অনেক দিন লাগবে লন্ডন যেতে। জাহাজে বসে না থেকে হাতের কাজ অনুশীলন করছিলেন যুবকটি।
হলেনই বা ব্রিটিশ সরকারের অতিথি, নেটিভ তো বটে, শিল্পীর ঠাঁই হল জাহাজের খোলে, তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী হিসেবে। মাটি নিয়ে সহযাত্রীদের মূর্তি গড়েন। আবার ভেঙে ফেলেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন কচি কদাচিত জাহাজের খোলে আসেন। কেউ জানে না ওই ক্যাপ্টেন যখনই আসন, ওই শিল্পী বসে পড়েন মাটির তাল নিয়ে। ক্যাপ্টেনের অবয়ব যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ধরা পড়ে গেলেন। ক্যাপ্টেন নিজের মূর্তি দেখে বাকরুদ্ধ। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা নিয়ে কি করবে?’ যুবকটি জবাব দিলেন, ‘আবার মাটির তাল করে ফেলব। তারপরে অন্য কিছু বানাবো। ‘ আবদার ক্যাপ্টেনের,’এটা আমি নেব? বাড়িতে ফিরে সাজিয়ে রাখব।’
অগত্যা। তবে ক্যাপ্টেন কিন্তু পুরস্কৃত করেছিলেন যুবকটিকে। থার্ড ক্লাস থেকে তিনি উন্নীত হলেন ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীতে। সাহেবদের পাশে।
ওই যুবকটি আদতে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির বাসিন্দা। মামার কৌশল রপ্ত করে যৌবনেই সে মূর্তি বানানোয় দক্ষ। মোষ যখন গুঁতো মারতে এগোয়, তার পা এবং শরীরের পেশী গুলির অবস্থান কেমন হয়? কৃষ্ণনগরের ওই তরুণ মৃৎশিল্পীর কাজ দেখে তা পরিষ্কার হয়ে যেত। শুধু নিখুঁত উপস্থাপনাই নয়, আঙুলের জাদুতে মাটির তালকে নিমেষে হানাদার মোষ কিংবা ছুটন্ত ঘোড়ায় রূপান্তরিত করত যুবকটি।
ওই যুবকটির কথা ছড়িয়েছে কলকাতা পর্যন্ত। সেটা নেহাতই কথার কথা না বাস্তব তা নিয়ে খটকা ছিল অনেকেরই। তৎকালীন ছোটোলাট কারমাইকেল তাঁদের একজন। ঘটনাচক্রে একদিন কৃষ্ণনগরে এলেন ছোটোলাট। ঠিক করলেন এই সফরেই যাচাই করবেন ওই যুবকটির হাতের কাজ। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কারমাইকেল সাহেব হাজির হলেন ওই যুবকটির মামার স্টুডিওতে। কোনও পশুপাখি নয়, অসুরের সঙ্গে মা দুর্গার যুদ্ধের কিছু মুহুর্ত নিমেষের মধ্যে তৈরি করে দেখালেন যুবকটির। ছোটোলাট শুধু খুশিই হলেন না, যুবকটিকে ‘দ্য লাইটনিং স্কাল্পচার’ (বিদ্যুৎগতির ভাস্কর) উপাধি দিলেন। কারমাইকাল সাহেবের ওই সার্টিফিকেট যুবকটির ভবিষ্যতের পথ অনেকটাই মসৃন করেছিল।
পরবর্তীকালে কলকাতার পুজোয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এখন আমরা বারোয়ারি পুজোর মন্ডপে যে পাঁচ চালা প্রতিমা দেখি, অর্থাৎ মা দুর্গা, অসুর, সিংহ, মহিষ এক কাঠামোয়। মা দুর্গার তার ছেলেমেয়ে তাদের বাহনদের নিয়ে বাকি চারটি কাঠামোয়। ১৯৩৮ সালের আগে সব ঠাকুরই থাকত একচালা। এক দুর্ঘটনার জেরেই এমনটা হলেও, কলকাতার পুজোয় গোপেশ্বর পালকে অমর করেছে ওই ঘটনা। কিন্তু তাঁর প্রতিভার উন্মেষ হয়েছিল কলকাতায় আসার অনেক আগেই। যে গল্পটা আগেই বলেছি।
এত প্রতিভাবান শিল্পীকে কলকাতা কিন্তু সহজে গ্রহণ করেনি। কুমোরটুলির কাশী মিত্র ঘাট রোডের যে বাড়িটির এক চিলতে ঘরে জি পাল অ্যান্ড কোম্পানির পথ চলা শুরু, সেটি এখন গোপেশ্বর পালের উত্তরসূরীদের বাসস্থান। স্টুডিও তৈরি হয়েছে উল্টোদিকের জমিতে। যদিও জি পাল অ্যান্ড কোম্পানির সাইবোর্ডটি পাকাপোক্ত ভাবে বসানো আছে সেই পুরনো বাড়ির ছাদেই। একমাত্র ছেলে সিদ্ধেশ্বর নিঃসন্তান ছিলেন। বাবার মতো সিদ্ধেশ্বরের মৃত্যুও হয় অপরিণত বয়সে। সিদ্ধেশ্বরের স্ত্রী এখনও বর্তমান। স্টুডিওর হাল ধরেছেন সিদ্ধেশ্বরের শ্যালক ব্যোমকেশ পাল আর তাঁর পুত্রেরা। সিদ্ধেশ্বর পালের জীবনের কথা শুনিয়েছেন ব্যোমকেশবাবুই।
বিলেতের প্রদর্শনী থেকে স্বর্ণপদক জিতে কলকাতায় ফিরে কোথায় সংবর্ধনা পাবেন, গোপেশ্বর পালকে স্টুডিও চালু করতেই সমস্যায় পড়তে হল। তিনি ম্লেচ্ছদের সঙ্গে ওঠাবাসা করেছেন, তাই তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে বলে দাবি উঠল। ব্রাহ্মনদের তরফ থেকে আপত্তি উঠলেও, এর পিছনে কুমোরটুলির শিল্পীদের একটা বড় অংশও ছিলেন বলে শোনা যায়। এতবড় একজন ভাস্কর কুমোরটুলিতে কাজ করবেন, কাজ শেখাবেন। এটা যে কুমোরটুলির পক্ষেই গৌরবের সেটা কে বুঝবে! গোপেশ্বর পালকে বয়কট করা শুরু হল। ওয়ার্কশপে তাঁর সঙ্গে কাজ করার মতো কাউকেই পেলেন না তিনি। কুমোরটুলির নতুন প্রজন্মের একজন জগদীশ পাল একদিন বয়কট ভেঙে ওই ওয়ার্কশপে ঢুকলেন। তিনিই গোপেশ্বর পালের প্রথম ছাত্র। তারপরের অধ্যায় তো ইতিহাস।