দুর্গার উৎসসন্ধানে

দেবদূত ঘোষঠাকুর

দুর্গা শব্দের মানে কি? অভিধান বলছে, ‘সর্ববিধ দুঃখ, দুর্গতি ও ভয় যিনি হরণ
করেন তিনিই দুর্গা’। আমরা যে দেবীর পুজো করি তিনি আসলে দুর্গতিনাশিনী। এখন দেখা যাক পুরাণ কি বলছে? স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে, রুরুদৈত্যের পুত্র দুর্গাসুরকে বধ করেই তিনি দুর্গা- ‘তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমখ্য মহাসুরম্’।
শুধু রুরুকেই নয় তিনি বিভিন্ন সময় মধুকৈটভ, শুম্ভনিশুম্ভ, মহিষাসুর, দুর্গামাসুর ইত্যাদি অত্যাচারী দৈত্যদের হত্যা করে সবার দুর্গতি নাশ করেছিলেন বলেই তিনি দুর্গা। ধারণা অনুসারে যিনি বিভিন্ন প্রকার বাধা বিঘ্ন, রোগ-শোক, পাপভয়, শত্রু ও থেকে মুক্ত করেন তিনিই দুর্গা। 
কৃষ্ণ যজুর্বেদের যজুর্বেদের তৈত্তেরীয় আরণ্যকে প্রথম দুর্গা শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে-
তাং অগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম,
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরমে নমঃ।।
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক-১০/২)
(অগ্নিবর্ণা তপ প্রদীপ্তা সূর্য ( বা অগ্নিস্বরূপিণী) যিনি কর্মফলের প্রার্থিত হন, সেই দুর্গাদেবীর আমি শরণাপন্ন হই, হে সুন্দররূপে, ত্রাণকারিণী, তোমাকে নমস্কার।) ঋগবেদে দেবীসুক্ত যা দুর্গাপূজায় চন্ডীপাঠের পূর্বে পাঠ করা বিধি আছে, সেখানে দেবীকে পরমা প্রকৃতি, নির্বিকারা ও জগতের ধাত্রীরূপে বর্ণিত আছে।
এই দুর্গা আবার জগতের কল্যাণকারী তাই তিনি জগৎজননী। তিনি ভক্তদের ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ দান করেন বলেই তিনি সর্ব কামার্থদায়িনী। তিনি জগতের অন্নদাতা, তাই তিনি অন্নদা। রুদ্রের ঘরনি তাই তিনি রুদ্রাণী। শত অক্ষির দ্বারা তিনি সকল কিছুই লক্ষ করে থাকেন বলেই তিনি শতাক্ষী। তিনি পরম বৈষ্ণব তাই তিনি বৈষ্ণবী, তার অঙ্গকান্তি গৌরবর্ণা তাই তিনি গৌরী এবং পর্বত দুহিতা তাই পার্বতী। তিনি বহু নামের অধিকারনী। আমাদের রক্ষাকর্ত্রী দুর্গা সম্পর্কে চন্ডী বলছে- ‘বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপাতংস্থিরূপা চপালনে। তথাসংহৃতি রূপান্তে জগতোহস্য জগন্ময়ে।।’
যাজ্ঞিকা উপনিষদে দুর্গার গায়ত্রী আছে- ‘কাত্যায়নার বিমতে কন্যাকুমারীং ধীমহি তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াৎ।’ এখানে দুর্গা সম্বোধনপদে দুর্গি হয়েছে। এতে কাত্যায়নী বা কন্যাকুমারী দুর্গার অপর নাম তা সকলেই জানে। এছাড়া গোপাল তাপনী উপনিষদ, নারায়ণ উপনিষদ ইত্যাদি বৈদিক গ্রন্থে দুর্গার উল্লেখ আছে।
দুই বাঙলায় মা দুর্গা যে রূপে পূজিত হন, সেই রূপ কিন্তু বিশ্বজনীন নয়। দুই বাঙলায় মা হলেন দশভুজা। তিনি মহিষাসুর বধে উদ্যতা। সিংহবাহিনী। বামে লক্ষ্মী ও গণেশ। ডাইনে সরস্বতী ও কার্তিক। মহিষাসুরমর্দিনীরূপে তিনি পূজিতা হন। উত্তর ভারতে দেবী দুর্গার রূপ কিন্তু এমন যুদ্ধংদেহী নয়। দেবীর সেখানে আট হাত। হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও শান্তভাবে হাসিমুখে তিনি সিংহ বা বাঘের পিঠে বসে। এক হাত রয়েছে আশীর্বাদ মুদ্রায়। দক্ষিণভারতে দুর্গার তার হাত। তিনি পদ্মাসনা। রূপ যা-ই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই তিনি কল্যাণকাররিণী।
দুর্গা কিন্তু সবার চোখে কল্যাণকরী নন। পূর্ব ভারতের একটি জনজাতি গোষ্ঠীর কাছে দুর্গা দুর্গতিনাশিনী নন। বরং তিনি দুর্গতদায়িনী।
এ আবার কেমন কথা? পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার, ওড়িশায় বসবাসকারী
অসুর গোষ্ঠীর জনজাতিরা মনে করেন, ছলনা করে ওই দেবী তাঁদের এক রাজা হুদূড় দুর্গাকে বধ করেছিলেন। সেটা আর্য-অনার্যের যুদ্ধের পরিনতি। সাঁওতাল লোকগাঁথায় বলা হয়েছে, হুদুর দুর্গার সুশাসনে আর্যরা শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। ছলে বলে কৌশলে তারা হুদুর দুর্গাকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল। রাজ্য বিস্তারের পক্ষে মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওই আদিবাসী রাজা। তাঁকে পরাস্ত করতে মায়াবী এক নারীর সাহায্য নিয়েছিল আর্যেরা। অসুর জনজাতি মানুষদের বিশ্বাস, ওই মায়াবী নারীই দুর্গা। হুদুর দুর্গাকে কৌশলে হত্যাকারী ওই নারীর নামই দুর্গা।
তাই দুর্গাপুজোর সময়টা ওই জনগোষ্ঠীর মানুষ শোক পালন করেন। আর মতোই সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি এড়িয়ে পড়ছে, ততোই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বছর বছর শোকসভার সংখ্যা বাড়ছে।

Share