১০৮ টি-ই জবা কেন

দেবদূত ঘোষঠাকুর

কেউ তুষ্ট ১০৮ টি বেলপাতায়। কারও জন্য দরকার ১০৮টি পদ্মফুল। কাউকে খুশি পারে স্রেফ ১০৮ টি তুলসি পাতা। আবার কেউ কেউ আছেন যাঁদের ১০৮ টি জবা ফুলে গাঁথা মালা না হলেই দেবীর আসন টলমল করে উঠতে পারে।
কেউ আবার মন্দিরে ‘শ্রী শ্রী ১০৮’ লিখে পাপ ঘোচানোর চেষ্টা করেন। জপের মালায় থাকে ১০৮ টি রুদ্রাক্ষ।
শিবের কেন দরকার ১০৮ টি বেলপাতা, দুর্গার ১০৮ টি পদ্ম, বিষ্ণুর ১০৮ টি তুলসি আর মা কালীর ১০৮ টি জবা দিয়ে গাঁথা মালা? জপের মালায় কেনই বা থাকতে হয় ১০৮ টি রুদ্রাক্ষ? এই ১০৮ -য়ের রহস্যটা কি?
এক পন্ডিতের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনায় যে বিষয়টি বেরিয়ে এলো তা হল, হিন্দুধর্মে ১০৮ সংখ্যাটি অতি পবিত্র। হিন্দুধর্ম মতে ১০৮ সংখ্যাটি দ্বারা ব্রহ্মকে প্রকাশ করা হয়। তাই হিন্দুধর্মে ১০৮ সংখ্যাটির এত গুরুত্ব। বর্ণমালায় যে সব বর্ণ পরপর সাজানো আছে, বর্ণমালায় তাদের অবস্থান অনুযায়ী ব্রহ্মের ‘ব’ ২৩ নম্বর বর্ণ। ‘র’ ২৭ নম্বর, ‘হ’ ৩৩ এবং ‘ম’ ২৫ নম্বর। ২৩, ২৭, ৩৩ আর ২৫ রোগ করলে দাঁড়ায় ১০৮।
কেউ কেউ বলছেন, প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় ৫৪টি অক্ষর ছিল। প্রতিটি বর্ণের পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ, অর্থাৎ শিব ও শক্তি বর্তমান। সেই অনুযায়ী ৫৪x২= ১০৮। প্রাচীন মুহূর্ত শাস্ত্র অনুসারে, সময়কে ১০৮টি উপলব্ধিতে বিভাজিত করা হয়। ৩৬ অতীত, ৩৬ বর্তমান, ৩৬ ভবিষ্যৎ। হিন্দুধর্মের পঞ্চদেবদেবী, যাঁরা শাস্ত্রানুসারে সর্বাগ্রে পূজিত (গণেশ, বিষ্ণু, শিব, কৌশিকী বা চণ্ডী এবং সূর্য বা আদিত্য), প্রত্যেকেরই অষ্টোত্তর শতনাম সংকীর্তন করা হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ সর্বদা ১০৮ জন গোপিনীর সঙ্গে লীলাখেলায়রত থাকতেন।
১০৮-কে সংস্কৃতে বলা হয় ‘হর্ষদ সংখ্যা’। কারণ, এই সংখ্যাকে তার সংখ্যা-সমষ্টি দিয়ে বিভাজিত করা যায়। ১+০+৮=৯, আবার ১০৮/৯=১২। আয়ুর্বেদ ও যোগ শাস্ত্রমতে, মানবদেহে মোট ১০৮টি পথ ধরে চালিকাশক্তি এসে হৃদপিণ্ডকে সচল রাখে। কালজয়ী মহাকাব্য মহাভারতে প্রত্যেকটিতেই ১৮টি অধ্যায় আছে। এমনকি শ্রীরামচরিত মানস ৯ দিনে পাঠ সম্পূর্ণ করতে হয়, যাকে ‘নবাহ্ন পরায়ণ’ বলা হয়। নটরাজের তাণ্ডবের থেকে প্রেরিত হয়ে ‘ভরতনাট্যম’-এর সৃষ্টি সেই নৃত্যশাস্ত্রে ১০৮টি হস্ত ও পদ্মমুদ্রা আছে। সারা ভারতে তন্ত্রপীঠের সংখ্যাও ১০৮।
ধর্মীয় রীতিতে বৈচিত্র থাকলেও হিন্দু, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে জপমালার পূঁতির সংখ্যা সর্বক্ষেত্রেই ১০৮। কেন ১০৮টি পুঁতি জপমালাতে থাকে তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ ধর্মে রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, একটি সূত্র— ৬ x ৩ x ২ x ৩= ১০৮, অর্থাৎ ৬ হল মানুষের ছয়টি ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও চিন্তা), ৩ হল ত্রিকাল (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত্), ২ হৃদয়ের দু’টি অবস্থা (নির্মল ও কলুষিত) এবং ৩ হল মানুষের মনের অবস্থা (ইচ্ছা, অনিচ্ছা ও উদাসীনতা)। জপের মূল উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা, মনের পরিচালনা করা এবং কালের ঊর্ধ্বে নিজের হৃদয়কে প্রতিস্থাপন করা।

Share