মুশকিল আসান ফোরাম

পার্থ ঘোষ

‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, প্রাক্তন সভাপতি

সেটা ছিল ২০০৯ সাল‌। পুজোর আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। প্রস্তুতি তখন শেষ পর্যায়ে। পুলিশ কমিশনার তাঁর বাহিনী নিয়ে বিশেষ কয়েকটি পুজোমণ্ডপ পরিদর্শনে বেরোচ্ছেন প্রতিদিন।

দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজোয় একদিন সকালে এসে হাজির ওই পরিদর্শক দল। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে দেখে, অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা ইঙ্গিত দিয়ে গেল, এবার আর এই পুজোটি হচ্ছে না। সবার মাথায় যেন বাজ পড়ল। সত্যিই কি প্রশাসন এবার পুজোটা বন্ধ করে দেবে? বুঝতে পারছেন না কেউই। ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু বেলা একটায় দমকল দফতরের যে চিঠিটি স্থানীয় থানা থেকে এসে দিয়ে গেল, সেটি মৃত্যু পরোয়ানা— সেবারের মতো পুজো বন্ধ রাখার নির্দেশ। বলে দেওয়া হল, চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করার পরমুহূর্ত থেকে বন্ধ করে দিতে হবে প্রস্তুতির সব কাজ। সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হল ওই মণ্ডপ। উদ্যোক্তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সংবাদমাধ্যম ভিড় জমাল পুজোপ্রাঙ্গণে। ছবি উঠতে লাগল পটাপট।

সংবাদমাধ্যমে প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের কথা ছড়িয়ে পড়ল। অনেক পুজো কমিটি ছুটে এল। কেউ যোগাযোগ করল ফোনে। অন্য একটি ক্লাবের পাঁচ সদস্য (পঞ্চপান্ডব) ঘন ঘন যাওয়া-আসা শুরু করে দিলেন ওই মণ্ডপে। তাঁদের একটাই আর্জি, “এ বছর আপনাদের পুজো বন্ধ করেছে। পরেরবার একই ভাবে বেশ কয়েকটি পুজোর প্রস্তুতি বন্ধ করে দেবে। কিছু একটা করুন।”

ওদিকে বিভিন্ন মহল থেকে ইতিমধ্যে চাপ আসতে শুরু করে দিয়েছে। শোনা গেল, প্রশাসনের কর্তারাও ঘন ঘন বৈঠক করছেন। চার দিন পরে বরফ গলতে শুরু করল (এই বরফ গলাতে যাঁরা হস্তক্ষেপ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাংবাদিক দেবদূত ঘোষঠাকুরের নাম উল্লেখ করতেই হয়। এছাড়া ছিলেন আরও কিছু বন্ধু)। প্রশাসন জানাল, আরেকবার মণ্ডপ পরিদর্শন করা হবে। সেই পরিদর্শক দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

পরিদর্শক দল এল। সব ঘুরে-ঘুরে দেখল। কথাবার্তা হল শিল্পীর সঙ্গেও। ছয় ঘণ্টার পরিদর্শনের পর দলের একজন জানালেন, “আমরা সন্তুষ্ট।” নিমেষে বদলে গেল আবহাওয়া। মিষ্টি এল। কিছুক্ষণের মধ্যে সরকারি নির্দেশনামার প্রতিলিপি পৌঁছে দিয়ে গেল স্থানীয় থানা। বেঁচে গেল ওই পুজোটা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এল লেক টেম্পল রোডের শিবমন্দিরের পুজো। ঘটনাচক্রে আমি ছিলাম ওই পুজোর সম্পাদক। কলাগাছের নানা অংশ দিয়ে সেবার সেজেছিল মণ্ডপ। ভালোভাবে শেষ হল পুজো।

পুজো শেষ হল বটে, কিন্তু সঙ্ঘশ্রীর ওই পঞ্চপান্ডব— সাম্য, দেবাশিস, সুখেন্দু, সৌরদীপ আর কৌশিক কিন্তু ছিনেজোঁকের মতো লেগে রইল আমাদের সঙ্গে। তাঁদের সেই একই কথা, “এবার না হয় উতরে গেলেন, সামনের বছর কি হবে? ফের কোনও ক্লাবের এই একই সমস্যা হলে তখন কি হবে?” ওদের কথায় যে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। আলোচনার জন্য এক সন্ধ্যায় গেলাম পঞ্চপান্ডবের ডেরায়। বেশ কয়েকটি পুজো-কমিটির নাম উঠে এল। উঠে এল কয়েকজন পুজো-উদ্যোক্তার নাম। ঠিক হল, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখা যাক কী দাঁড়ায়। এই আড্ডা ধীরে ধীরে রোজকার আড্ডার চেহারা নিল। কসবা বোসপুকুরের কাজল সরকার যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। বিভিন্ন পুজো-কমিটির তালিকা তৈরি হল। যোগাযোগ করা হল আরও অনেকের সঙ্গে। রোজ রাতে তালিকায় নতুন নতুন পুজোকমিটির নাম যুক্ত হতে শুরু করল। সবাই অপেক্ষায় ছিল এরকমই কিছু একটা হোক, কলকাতার সব ক’টি পুজো-কমিটি একসঙ্গে মিলে কিছু একটা করুক।

বছর ঘুরল। শুরু হল নতুন লড়াই। ঠিক হল, যেসব পুজো-কমিটি সংগঠন করার পক্ষে তাদের সবাইকে ডেকে মিটিং করা যাক। তাতে কে, কী, কেমনভাবে ভাবছে তা পরিষ্কার হবে। প্রথম মিটিং জানুয়ারিতেই ফেলা হল। মিটিং বসল সঙ্ঘশ্রীতে। সেখানে উপস্থিত হলেন কলকাতার ৬৫টি পুজো-কমিটির প্রতিনিধিরা। নানারকম মতামত এল। কে কী বললেন সব লিখে রাখা হল। কিন্তু কোনও কিছু চূড়ান্ত হল না।

এর আগে সাময়িকভাবে বিপদে পড়ে একটি ক্লাব তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি কমিটি করেছিল। তা বেশিদিন টেকেনি। আমরা চেয়েছিলাম দীর্ঘস্থায়ী সংগঠন। তাই আমরা এগোতে চাইলাম খুবই সতর্কভাবে।

ঠিক হল, পরের মিটিং হবে হাতিবাগানের নলিন সরকার স্ট্রীটে। আমরা চেয়েছিলাম পরপর অন্তত তিনটি মিটিং করতে। যদি ওই তিন মিটিংয়ের প্রতিটিতেই ৫০টি পুজো-কমিটি হাজির থাকে, তখন আমরা সংগঠন গড়ার পথে এগিয়ে যাব। দ্বিতীয় মিটিংয়ে হাজির ছিল ৫০টির বেশি পুজো কমিটি। পরিকল্পনা মতো তৃতীয় মিটিং ফেলা হল মার্চে। ফের সঙ্ঘশ্রীতে। এবার উপস্থিতির হার আশাব্যঞ্জক। ৭০-এর কাছাকাছি গিয়ে থামল তা। দেখা গেল ৬০-৭০টি পুজো-কমিটি আন্তরিকভাবে চাইছে, পুজোওয়ালাদের একটি সংগঠন তৈরি হোক‌। সেই মিটিংয়েই সংগঠন তৈরির সিদ্ধান্ত হল। নামও ঠিক হল— ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’। এবার আমরা ছড়িয়ে পড়লাম গোটা শহরে। রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত হানা দিতে লাগলাম বিভিন্ন পাড়ায়। আমাদের সঙ্গে বেহালা থেকে যোগ দিল সন্দীপন, নিউ আলিপুর থেকে স্বরূপ, বোসপুকুর তালবাগানের শুভেন্দু, খিদিরপুর থেকে রাজেশ, উত্তর থেকে নিশীথদা, সন্তোষপুর থেকে রানা— সঙ্গে এমন আরও অনেকে।

ভিতরে ভিতরে আমরা কিন্তু রেজিস্ট্রেশনের কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমাদের আইনগত পরামর্শদাতা প্রলয় রায়ের চেম্বারটাই তখন ছিল আমাদের অফিস। কাগজপত্র জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন পেতে সময় লাগল দেড় মাস। এরপরেই সাংবাদিক দেবদূতবাবুর সহযোগিতায় আমরা কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করলাম। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই, ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করল ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’, পুজোওয়ালাদের একমাত্র সংগঠন। সেই খবরটা প্রচারিত হতেই ফোন আসা শুরু হয়ে গেল। ফোরামের সদস্যসংখ্যা বাড়তে লাগল হু-হু করে। খোলা হল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। তৈরি হয়ে এল প্যানকার্ড। ২০১০ সালের পুজোর আগে ফোরামের সদস্যসংখ্যা সেঞ্চুরি হাঁকালো।

১২০টি পুজো-কমিটিকে নিয়ে ফোরাম তো হল, কিন্তু পুজোগুলি বিপদমুক্ত হল কই? নানারকম হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছিল অনেক পুজো-কমিটিকেই। ২০১০ সালে উত্তর কলকাতার এক পুজো-কমিটি চিঠি পেল, পুজো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যে নিয়ম প্রশাসন করেছিল তা মানতে গেলে ওই পুজো বন্ধ করে দিতে হয়। আমরা দেখলাম ওই নিয়মেই গলদ রয়েছে। বিভিন্ন পুজো-কমিটির সমস্যা ভিন্ন। তাদের সবাইকে এক নিয়মে বাঁধতে গিয়েই যত বিপত্তি। এক-একটা পুজোর সমস্যা নিয়ে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম। তৈরি হল পুজোভিত্তিক নিয়মাবলী। সেই নিয়মটা আজ ১০ বছর পরেও রয়ে গিয়েছে।

ফোরামের স্লোগানও তৈরি হল সেই সময়ে : আমরা চাই বন্ধুত্বপূর্ণ প্রশাসন, যুক্তিপূর্ণ সমাধান। পুজো-কমিটির আসা কিন্তু বন্ধ হল না। প্রশাসনিক মহলে স্বীকৃতি পেল আমাদের ফোরাম। সিইএসসি-র বিলের অনেক অসঙ্গতি দূর হল। এসবই আমরা একসঙ্গে থাকার জন্যই সফল হল‌। আমরা কেবলমাত্র পুজোতেই কিন্তু আটকে থাকলাম না। সামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়লাম। কোভিড-১৯, আমফানের ত্রাণে যেমন সবার আগে ফোরাম, তেমনই রক্তদানে আমরা নজির সৃষ্টি করেছি। আমরা আছি মানুষের কাছাকাছি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।

Share