জাম্বিয়ার পুজো

বিশ্বজিত চ‍ৌধুরী, লুসাকা, জাম্বিয়া

তিনজন বাঙালি এক জায়গায় হলেই নাকি পুজো, নাটক, ক্লাব শুরু হয়ে যায়। হয়তো বাঙালি চাঁদে পৌঁছেও প্রথমে এই কাজটাই করবে।

ঘন জঙ্গলের অনুন্নত দেশ আফ্রিকার জাম্বিয়ার লুসাকা শহরে যে কত ধুমধাম আর আনন্দ করে প্রত‍্যেক বছর দুর্গাপূজা হয়, তা না দেখলে বিশ্বাসই হবে না।

এই সবুজ শহর লুসাকাতে বহু বাঙালি পরিবার শান্তিতে আছে। কেউ ৩০, কেউ ৪০, কেউ বা ৫০ বছর ধরে। এরা অনেকেই এসেছিলেন এক-দু’বছরের জন‍্য। কিন্তু কালো মানুষদের সারল্যে আর ভালোবাসায় পরভূমি হয়ে গেছে নিজের দেশ।

নতুনরা এখানে এসে খুব কম সময়েই মিশে যায় এখানকার বন্ধুবৎসল আন্তরিক বঙ্গসমাজে। তাই দুর্গাপূজা বা অন‍্য পূজায় নতুন আর পুরোনো সভ‍্যরা মিলে সুন্দর করে তোলে ধর্মীয় আরাধনা।

প্রত‍্যেক বছরের শুরুতে একটি নতুন কমিটি ‘ইলেকটেড’ বা ‘সিলেকটেড’ হয়— বিভিন্ন পূজা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিকনিক আর অন্যান‍্য বিনোদন পরিচালনার জন‍্যে। সবাই মিলে ঠিক হয় সারা বছরে কী কী হবে আর তার খরচ সবাই সমানভাবে ভাগ করে নেন। যদিও এই লুসাকার বঙ্গসমিতির কোনও রেজিস্ট্রেশন নেই, তাও সুজন-স্বজনের নিবিড় বন্ধুতায় যে আত্মীয়তা গড়ে ওঠে তার জন‍্যে বঙ্গীয় সমাজের স্বার্থে যে কোনও সিদ্ধান্তই পরিচালন কমিটি সহজেই নিতে পারে।

লুসাকায় দূর্গাপূজা শুরু হয় মহালয়ায়। এখানকার বহু বাঙালির বিরাট বাড়ি, আর তার সঙ্গে আছে ছোটখাটো মাঠের মতো খোলা জায়গা বা লন। এরকমই কোনও এক বাড়িতে কমিটি ঠিক করে মহালয়া অনুষ্ঠান। মহিলারা আসেন নতুন শাড়িতে আর ছেলেরা বাংলার অভিনব সব পাঞ্জাবিতে। বিদেশেই যেন স্বদেশ। কমিটির সভ‍্যদের ঘরে-ঘরেই তৈরি সুস্বাদু ভোজ একসঙ্গে খাওয়া আর তার সঙ্গে আড্ডার মজাই আলাদা।

লুসাকার রামকৃষ্ণ বেদান্ত সেন্টারে অত্যন্ত নিষ্ঠা আর ভক্তি সহকারে ভারতীয় সময়ের নির্ঘন্ট মেনে দুর্গাপূজা হয় বহু বছর ধরে, যার শুরু পঞ্চমী থেকে। পূজা, অঞ্জলি আর আরতির সময়ে ভিড় করে সবাই। নতুন শাড়ি আর জামাকাপড়ে সবাই ঘেমেনেয়ে হয় অস্থির! রোজই সন্ধ্যায় থাকে বড়ো বা ছোটদের নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রোজই হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারপর কমিটির মহিলাদেরই নিরলস পরিশ্রমে তৈরি অসাধারণ সব খাবার খেয়ে সবাই আবার তরতাজা হয়ে যান পরের দিনের জন‍্য।

বাঙালিরা সবাই একদিন অন‍্য কমিউনিটির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানান পূজায় আর অনুষ্ঠানে। তাই বাঙালি ছাড়াও লুসাকার দুর্গাপূজা ভারতীয়দের মহাপূজা। ভারতীয় দূতাবাস, লুসাকার মেয়র এবং সরকারের কিছু উচ্চপদস্থ অফিসার আমন্ত্রিত থাকেন।

বহু মানুষ, যাঁরা নিজের দেশে বা অন‍্য দেশে চলে গেছেন, তারা পূজার সময় এলেই লুসাকায় ফিরে আসতে চান।

লুসাকার প্রতিমার বির্সজন হয় না। কারণ, পরিবেশ দূষণের সরকারি নির্দেশিকায় নদী বা জলাশয়ে কিছুই ফেলা বারণ। একই মূর্তি কয়েকবছর ধরে পূজা হয়। আর তার পর সংরক্ষিত হয় মন্দিরে বা কোনও সভ‍্যের বাড়িতে।

লুসাকার রামকৃষ্ণ বেদান্ত সেন্টার বহু পুরনো হলেও মাঝে বেশ কয়েকবছর কোনও মহারাজ ছিলেন না মন্দিরে। আর বেলুড় মঠ থেকেও বিচ্ছিন্ন ছিল। সেই বেদনাদায়ক পরিস্থিতি আর নেই। স্থায়ী মহারাজ এসেছেন। লুসাকার রামকৃষ্ণ বেদান্ত মন্দির আরও বড়ো হয়েছে। আর ভারতের বিভিন্ন রাজ‍্যের মানুষ এবং কিছু জাম্বিয়ানরাও আসেন ভক্তিতে আর শান্তির খোঁজে।

এই মন্দিরে এখন বেলুড় মঠের নির্দেশে উপাসনা আর ঠাকুরের গান ছাড়া অন্যান‍্য লঘু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ। তাই লুসাকায় গত কয়েক বছর ধরে দুটো দুর্গাপূজা হয়। একটি হয় মন্দিরে— বেলুড়ের নিয়ম মেনে, আর অন্যটি হয় বারোয়ারি পূজা হিসেবে কোনও হল ভাড়া করে। প্রায় সকলেই এই দু’টো পুজোকেই নিজেদের পুজো মনে করেন, আর বিভিন্ন সময়ে উপস্থিত হন দুই প্রাঙ্গণেই।

Share