যা হারিয়ে যায়

দেবদূত ঘোষঠাকুর

আমরা যে মহিষাসুর মর্দিনী এখন সব জায়গায় শুনি, রেডিওতে কিংবা সিডিতে তা ১৯৭২ সালে করা। এই শিল্পী তালিকায় অনেকেই নেই যাঁরা মহালয়ার ভোরে রেডিও স্টেশনে বসে লাইভ প্রোগ্রাম করতেন। একবার বা টানা অনেকবার।
শুধু শিল্পী পরিবর্তনই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কথা, গান এমনকী স্লোকও বাদ পড়েছে। প্রথমে এক ঘন্টার অনুষ্ঠান ছিল। পরে দুই ঘন্টার অনুষ্ঠান হয়। থেকে অনুষ্ঠান হয়েছে দেড় ঘন্টার। তাই এই পরিবর্তন। অনুষ্ঠানের প্রথম গাইতেন কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি, প্রভাবতী প্রমুখ। পঙ্কজ মল্লিক ছাড়া এঁদের কারওরই কণ্ঠ পরে আর শোনা যায়নি।
পুরনো নথি থেকে জানা যায়, যেমন ১৯৪০-এ গাইতেন পঙ্কজ মল্লিক, অনিল দাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শৈলদেবী, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), কল্পনা হাজরা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে গেয়েছেন জগন্ময় মিত্র, রাধারানী দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, শচীন গুন্ত, বাঁশরী লাহিড়ি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মজুমদার, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ। এঁদের গানও পরবর্তীতে আর যায়৷ শোনা যায় নি। জানা যায়, শৈল দেবী গাইতেন, ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৪০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে গাইতেন, ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী। সেই সব গানের কলি পুরোপুরি ফিরিয়ে গিয়েছে। সংরক্ষণ করা যায়নি। স্থায়ী রেকর্ডে তাঁদের কারও কন্ঠই কিন্ত নেই। এমনকী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলাও।
স্থায়ী রেকর্ড বলা হচ্ছে কেন? ১৯৩২ সাল ১৯৬২ অবধি থেকে লাইভ সম্প্রচার-ই হত। কেবল রেকর্ডারের অনুন্নত মানের জন্য ২-৩ বছর অন্তর নতুন করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং করতে হত। স্থায়ী রেকর্ডিং হয় ১৯৭২ সালে।
মহিষাসুর মর্দিনীতে পরিবর্তন শুধু শীল্পীতেই নয়। হয়েছে সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রেও। অল ইন্ডিয়া রেডিওর পুস্তিকা বেতার জগতের পুরনো সংখ্যা থেকে জানা যায়, প্রথম দিকে এই সঙ্গীত আলেখ্যর সঙ্গীত ফরীচালক পঙ্কজ কুমার মল্লিক একা ছিলেন না, তাঁর সঙ্গে ছিলেন ১৯৩২ সাল ১৯৬২ অবধি থেকে লাইভ সম্প্রচার-ই হত। কেবল রেকর্ডারের অনুন্নত মানের জন্য ২-৩ বছর অন্তর নতুন করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং করতে হত।
শুধু শিল্পীই নয়, পরিবর্তন হয়েছে সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রেও। যেমন প্রথম কয়েক বছর রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। তখন অনুষ্ঠানের নাম মহিষাসুরমর্দিনী কিন্তু ছিল না। কি ছিল তার জানতে আমাদের চলে যেতে হবে গত শতাব্দীতে।
তখনও নাম আকাশবাণী হয়নি। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কার্যালয় তখন ছিল ডালহৌসির গাস্টির্ন প্লেসে (১৯৫৬ সালে আকাশবাণী নাম হয়। তখন অল ইন্ডিয়া রেডিও চলে এসেছে বর্তমান জায়গায়)। ১৯২৭ সালে বোম্বের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি কলকাতায় তৈরি করেছিল বেতার কেন্দ্রটি। নাম হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও।
সেই সময় ভারতীয় ও সাদা চামড়াদের জন্য পৃথক অষনূষ্ঠান হত। ভারতীয়র দেখভাল করতেনদের জন্য অনুষ্ঠানের অধিক(র্তা ( প্রোগ্রাম ডিরেক্টর)) নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। এক কথার মানুষ ছিলেন তিনি। মহিষাসুর মর্দিনী (তখন নাম দেওয়া হয়েছিল প্রত্যুষ প্রোগ্রাম)। ওই অনুষ্ঠানে চন্ডীপাঠের জন্য অব্রাহ্মণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম ওঠায় বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও তাকে পাত্তাই দিলৈন না নৃপেনবাবু। তিনি বললেন, “করবে তো একটা প্রোগ্রাম, তার আবার বামুন কায়েত কি? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান, খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী সবাই তো বাজাবে, তা হলে তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়।”
১৯৩২ সালে ষষ্ঠীর ভোরে প্রত্যুষের প্রোগ্রাম সফল হয়েছিল। পরের বছর ষষ্ঠীর ভোরে একই অনুষ্ঠান ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’ হিসেবে সম্প্রচারিত হয়েছিল। ১৯৩৪ সালে প্রভাতী অনুষ্ঠানের সময় বদল হয়ে মহলয়ার ভোরে চলে আসে। ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানের নতুন নাম ডড়য় মহিষাসুর বধ। সঙ্গীত পরিচালকের একক দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। অনেক শিল্পীর পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় গানেরও। ১৯৪৭ সালে নতুন নাম হয় মহিষাসুর মর্দিনী।
১৯৭৬ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণী কুমার, পঙ্কজ মল্লিকের মহিষিসুর মর্দিনী পরিবর্তন করে অল ইন্ডিয়া রেডিও -কর্তৃপক্ষ উত্তম কুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে কে দিয়ে মহালয়ার ভোরে নতুন অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। কিন্তু মানুষের প্রতিবাদে ষষ্ঠীর ভোরে পুরনো মহিষাসুর মর্দিনী বাজানো ড়য়। ১৯৭৭ সালের মড়িলয়ার ভোর থেকে বের বাজতে থাকে মহিষাসুর মর্দিনী।
তবে ১৯৭৬ সালই প্রথম নয়, ১৯৪৪ সালেও একবার এমনটা ঘটেছিল। পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে বেতার কর্তৃপক্ষের মতবিরোধে ১৯৪৪ সালে তাঁর জায়গায় প্রথমবার গানের সুর এক রেখে সঙ্গীত পরিচালনা করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৫ সালে অন্য গানসহ নতুন মহিষাসুরমর্দিনীনয় শোনানো হয়। সঙ্গীতপরিচালক করেন বিজনবালা ঘোষদস্তিদার ও শচীন দাশ মতিলাল। কিন্তু সেটি দর্শক গ্রহণ করেনি। ১৯৪৬ সালে পঙ্কজকুমার মল্লিকের প্রত্যাবর্তন ঘটে। আবার মানুষের ঘরে ঘরে বাজতে থাকে মহিষাসুর মর্দিনী।

Share