অসিত ঘোষ
আসুন জেনে নিই ‘অসুর’ শব্দের অর্থ কী ছিল।
‘অসুর’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় এক অতি অদ্ভুত, বর্বর, অত্যাচারী প্রাণীর প্রতিমূর্তি। বিশেষ করে ভারতীয় পুরাণে অসুর নিয়ে নানা কল্পকাহিনী আছে। দেবাসুরের যুদ্ধ, দেবতাদের হাতে নানান অসুর নিধন, দেবী দুর্গার হাতে বিভিন্ন অসুর নিধনের কাহিনী পুরাণের অন্যতম উপজীব্য বিষয়। পুরাণ অনুসারে অসুর অন্ধকারের, অত্যাচারের জাজ্বল্যমান নিদর্শন, যাদের হাতে মানুষ, দেবতা সবাই লাঞ্ছিত, নিপীড়িত। তবে দেখা যায়, অসুররা যতই দেবতা ও মনুষ্যবিরোধী হোক না কেন, তারাও পৌরাণিক ত্রিদেবেরই উপাসক।
এবার দেখা যাক, বৈদিক সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘অসুর’ শব্দের প্রকৃত অর্থ। যা সময়ান্তরে নিন্দাসূচক শব্দে পরিণত হয়েছে, তা কিন্তু সুদূর অতীতকালে সমাদৃত ছিল আমাদের সভ্যতায়। এই লেখাতে সেই বিষয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা করব। বেদের প্রথমভাগে যে শব্দ প্রশংসাসূচক ছিল তা পরবর্তী সময়ে কী কারণে নিন্দিত হল সেটা চিন্তার বিষয়। এই আলোচনা শুরুর আগে আমাদের জানা উচিত বেদোক্ত দেব ও অসুর কারা?
শতপথ ব্রাহ্মণ বলছে, “যজ্ঞেন বৈ দেবাঃ”— যারা যজ্ঞ করতেন তারা দেব। ‘দেবতা’ কথার অর্থ বিদ্বান ব্যক্তি। “বিদ্যাংসো হি দেবাঃ”— বিদ্বান তিন প্রকার দেব, ঋষি, পিতৃ।
তেমনি, ‘অসুর’ শব্দের অর্থ বীর, যোদ্ধা, জাজ্বল্যমান। ‘অসুর’ কোনও নিন্দাসূচক শব্দ না। ঋক্বেদে বহুবার প্রশংসাসূচক অভিবাদন স্বরূপ ইন্দ্র, সূর্য, বরুণকে ‘অসুর’ সম্ভাষণ করা হয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে দেবাসুরের সংগ্রামের কথা পাই, সেটা বাস্তবে শক্তির সঙ্গে প্রজ্ঞার লড়াই ছিল— যেখানে বিদ্বানরা জয়লাভ করেছিল, আর অসুররা পরাজিত হয়ে আর্যাবর্ত ত্যাগ করে পশ্চিমে অ্যাসিরীয় সভ্যতা স্থাপন করেন। কিন্তু আজ ইতিহাসবিকৃতির ফলে দেবতা বলতে অপার্থিব মহান শক্তি ও অসুর বলতে অদ্ভুত অত্যাচারী কিছু বোঝায়।
আসলে দেব বা অসুররা আমাদেরই মতো মানুষ। এই দুই দলই ভারতের দু’টি সুপ্রাচীন আর্যজাতি। তবে একদল যাজ্ঞিক, আর অন্যদল যজ্ঞরহিত। বেদে ১০৫ বার ‘অসুর’ শব্দের উল্লেখ আছে। তার মধ্যে ৯০ বারই প্রশংসাসূচক। যেমন, “অসুরঃ অসু ক্ষেপণে শত্রুণ্ ইত্যসুরঃ”— যারা শত্রুদের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে পটু তারা অসুর… এবং “অসুন্ প্রাণান রাতি দদাতি ইত্যসুরঃ”— যারা প্রাণদান করে, যাদের মধ্যে দুর্দম প্রাণশক্তির প্রকাশ দেখা যায়, সেই সমস্ত শক্তিশালী বীররাই অসুরপদবাচ্য।
যাস্ক তার ‘নিঘণ্টু ও নিরুক্ত’ গ্রন্থে (৩/৮) বলেছেন যে, অস্ ধাতু থেকে অসুর শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে, যাস্কের মতে ‘অসু’ শব্দের অর্থ শ্বাসবায়ু। বৈদিক যুগের প্রথম দিকে দেবশক্তিকেও ‘অসুর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। দেবশক্তির মধ্যে যারা বীর যেমন— রুদ্র, মরুৎ, বরুণ, ত্বষ্টা, অগ্নি, বায়ু, পুষা, সবিতা, সূর্য, আকাশ, ইন্দ্র— এঁদের বৈদিক ঋষিরা অসুর বলতেন।
১. মরুৎ (ঋগ্বেদ ৬৪/২)
২. রুদ্র (ঋগ্বেদ ৫/৪২/২১)
৩. ইন্দ্র (ঋগ্বেদ ৫৪/৩)
৪. বরুণ (ঋগ্বেদ ২/২৭/১০)
৫. অগ্নি (ঋগ্বেদ ৫/১২/১)
প্রথম প্রথম দেব ও অসুরের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ছিল। কিন্তু পরে ব্যক্তিত্বজনিত মতপার্থক্য হতে শুরু করে, এই বিরোধ ছিল মস্তিষ্ক আর পেশিশক্তির মধ্যে। উপনিষদে উল্লেখ আছে যে, সভ্যতার মধ্যভাগে দেবাসুরের যুদ্ধে পরমব্রহ্ম দেবানুকূলে ছিলেন তাই দেবতাদের জয় হয়েছিল। দেবতাদের নেতা ইন্দ্র বৃত্রাসুরকে পরাস্ত করেন, শত্রুতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘অসুর’ শব্দটি খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকল। যেমন, “অসুরাঃ রাক্ষসাঃ দেবনিন্দকাঃ”— ব্রাহ্মণে অসুরদের বৃত্র হিসাবে উপস্থাপন করল। বৃত্র মানে আবরণ, যা অন্ধকারের প্রতীক।
বৈদিক যুগের শেষভাগে যজ্ঞবাদী আর্যদের সঙ্গে অসুরদের বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। আর্য অসুরজাতির অধিকাংশ ভারত ত্যাগ করে পারস্য ও তুর্কিস্থানে গিয়ে বাস করতে থাকেন। বাকিরা প্রয়াগ, ছোটনাগপুর, তিব্বত ও কামরূপের দিকে চলে যান।
অসুরদের যে বড়ো দলটি ভারতের বাইরে চলে গিয়েছিল, আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগেই তারাই ব্যাবিলনে এক সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এই সাম্রাজ্যের নাম অসুর বা অ্যাসিরিয়া। টাইগ্রিস নদীর উপকূলে এদের যে রাজধানী স্থাপিত হয়, তার নাম অস্সুর। অ্যাসিরীয়দের ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’-তে ‘অহুর’ শব্দটি অসুর শব্দের অপভ্রংশ, অহুর মাজদা এই সভ্যতার পরমেশ্বরের নাম। অ্যাসিরীয় সভ্যতার রাজাদের নামগুলির মধ্যেও অসুর শব্দটি পাওয়া যায়, যেমন, অসুর-নাসিরপাল (Ashurnasirpal), অসুর-বনিপাল (Ashurbanipal)। মোট কথা, যাদের বাসস্থানের নাম অ্যাসিরিয়া বা অসুর, রাজাদের নাম ‘অসুর’ উপাধিযুক্ত এবং উপাস্য দেবতার নাম অসরি বা অস্সুর, তারাই ‘অসুর’ নামে অভিহিত।
ভারতীয় অসুরগণ দুর্গনির্মাণে পটু ছিলেন। বেদে তার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। শম্বর অসুরের ছিল ৯০টি দুর্গ (ঋ১/১৩০/৭)। বর্চী অসুরের লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা ছিল, তিনি নিজেও ছিলেন দুর্দান্ত বীর (ঋ ১০/১৫১/৩)। পিপরু অসুরের বড় কেল্লা ছিল। ঋগ্বেদে