শিল্পীর পুজোনামচা/৫

জেদ ও অবিচল থাকার পুরস্কার

দীপক ঘোষ

যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলে ছোটবেলা থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিলাম। একই বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র তার ওপর বিদেশি ভাষার ওপর অগাধ ভয়, কিন্তু বছর নষ্ট করা যাবে না তাই অন্য স্কুল থেকেই আমাকে আমাকে ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। অনেকটা পাড়া পরিবর্তন করার মত। কিন্তু ‘মন’ পড়ে থাকতো সেই প্রথম পাড়াতেই অর্থাৎ যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলেই। কারণ অধিকাংশ সমবয়স্ক সহপাঠীরা যে ওই স্কুলেরই। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন স্কুলের alumni association এ   সব বন্ধুরা একত্রে মজা করছি সেই সময় পাঁচিলের ওপার থেকে সুমন্ত রায় (মানে সোনা) বলে যাচ্ছে ‘দীপকদা আমাদের পুজোর ৫০ বছরের জন্য কি ভাবলে? যাইহোক তাড়াতাড়ি করো, উৎসাহ দমিয়ে রাখতে পারছিনা।’ ওই বাচ্চা ছেলেটার উৎসাহ আমার আবার পড়ানোর ডিসিশনটা চেঞ্জ করাতে বাধ্য করল। আমি জানতাম ওই ক্লাবের শ্রী বিজু পারেক জৈন ধর্মীয় তাই প্রথম বারেই তার মনকে আকৃষ্ট করার মতন একটা কাজের কথা বললাম, ‘দিলবারা টেম্পল’। তবে একটা শর্ত রেখেছিলাম যে – এই কাজ হবে সম্পূর্ণ আমার কথা মত এবং সেই অনুযায়ী তারা যেন ডেকোরেটরের সঙ্গে কথা বলে । ডেকোরেটরের দায়িত্ব আমার চাহিদা ও মাপ মত কাঠের স্ট্রাকচার করে দেবে এবং তার জন্য তার যা প্রাপ্য তা পুজো কমিটি থেকেই নেবে আর আমার যে খরচা তা পুজো কমিটি আমাকে দেবে। এতে এক কথায় সবাই রাজি, কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল দীপক ঘোষ এক কথার মানুষ। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আগের বছরের কাজ দেখে আমার ই পাড়ার দুটো ছেলে, শম্ভু  ও গদাই যারা গতানুগতিক থার্মোকলের কাজে অভ্যস্ত, এসে আমাকে বলেছিল দাদা তোমার সঙ্গে কাজ করতে চাই। তাই ২০০২ সালে শম্ভুকে নিয়ে চলে গেলাম মাউন্ট আবু (বেচারা সোনা তার transcription এর কাজের জন্য আমার সঙ্গে যেতে পারল না)। আমি খুব ছোট্ট বেলায় দিলওয়ারা দেখেছি সেখানে ছবিও তুলেছিল আমার মাসি (সাদা-কালো ছবি)। তবে সেখানে প্রাধান্য পেয়ে ছিল আমাদের আকৃতি, দিলওয়ারার কারুকাজ নয়! সঙ্গে সস্তার camera থাকলেও ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম ১৯৮৪ সালের পর থেকে ঐ মন্দিরে ছবি তোলা নিষেধ। মাথায় পড়লো বাজ! অগত্যা drawing খাতা নিয়ে দুপুর ১৩ টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুজনে মন্দিরে বসে আঁকা শুরু করলাম। ৬ দিন পর ভাবলাম আগে তো ছবি তোলা যেত, নিশ্চয়ই ওখানকার photographyর দোকানগুলোতে মন্দিরের ছবি পাওয়া যাবে।পেলাম ও তাই। তাতেও মন ভরলো না। চলে গেলাম যোধপুর শহরে সেখানেই যোধপুর ফোর্টে একটা জৈনিসিম-য়ের ওপর বিদেশী বই পেলাম যেটা আমাকে এই কাজটার জন্য ভীষণভাবে উপকার করেছিলো। যাইহোক ফিরে এসে পুজো কমিটিকে চার ধরনের এক পিস করে কাঠের পিলার করে দেওয়ার জন্য ডেকোরেটর কে বলতে বললাম যার ওপর আমরা থারমোকল কেটে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা ডিজাইনগুলো লাগিয়ে দেখে নেব এবং সেই অনুযায়ী বাহান্নটা পিলারের থার্মোকলের কাজগুলো করা শুরু করে দেবো। আমি যাতে কাজটা সময় মত না করতে পারি তার জন্য যত রকমের চেষ্টা করা যায় তাই করেছিল সেই ডেকোরেটর। আমার শুধু চাহিদা ছিল- যে কার্পেন্টার কে দিয়ে এতদিন আমরা কাজ করে এসেছি (তা আমার পাড়া হোক বা যোধপুর পার্কে) আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার দ্বারাই এই কাজ সম্ভব। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম ২০০১ সালে, ওর ব্যাবসায়িক বুদ্ধির ফলে সেই কাঠের মিস্ত্রী ও আমার মতোই সেই ডেকোরেটরের good book থেকে সরে গিয়েছিল। তাই সে অন্যান্য কার্পেন্টার ধরে এনে কাজটা করাতে চেয়েছিলো। অজ্ঞাতকুলশীল দের নিয়ে আমি কিভাবে এত বড় একটা risk নি বলুনতো? এর ফলে পুজো কমিটির পঞ্চাশ বৎসরের আশা নিয়ে খেলা করা হয় নাকি? তাই প্রত্যেকের টেস্ট নিয়ে তাদের রিজেক্ট করতে বাধ্য হই। একটা সময় এমন ছিল যে সেই ডেকোরেটরকে পুজো কমিটি বাধ্য হয়েই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। যাই হোক বিয়ে বাড়ি রক্ষার্থে তাকে একটু নরম হতে হয়েছিল। এরপর রঘুদা নামে এক কার্পেন্টার কে পাঠালো যে দ্য মডার্ন ডেকোরেটরের সর্দার ছিল। প্রথমেই সে আমায় বলেছিল, ‘আমি ঐ চারটে পিলার আপনার দেওয়া মাপ মত করে যদি না দিতে পারি তো আমি আর কাঠের কাজ করবো না।’ আমার এই চ্যালেঞ্জিং ওয়ার্ড খুব ভাল লেগেছিল তাই তাকে নিয়েই কাজ করতে রাজি হলাম। সত্যি যে চারটি পিলার করতে দিয়েছিলাম তাতে এক মিলিমিটারের ভ্যারিয়েশন পাইনি! তারপর শম্ভু গদাই কে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। যতই কাজের গতি বাড়ল, ততই বেশকিছু শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইল। তারমধ্যে যার নাম না করলেই নয় সে হলো ভাস্কর সরকার, যাকে নিয়ে আজ তাবড় তাবড় থিম মেকাররা টানাটানি করে। আস্তে আস্তে মন্দিরের shape যখন নেওয়া শুরু করল তখন ওই পুজোর এক কর্ণধার আশিস মুখার্জি আনন্দবাজারের সুমন চট্টোপাধ্যায় কে ক্লাবে নিয়ে আসেন। উনি আমাদের কর্মকান্ড দেখে সঙ্গে সঙ্গে অশোক মজুমদার কে ফোন করে যোধপুর পার্কের কাজ দেখে যাওয়ার জন্য বলেন। অশোকদা আসলেন সঙ্গে অনেক ছবিও নিলেন। তার ঠিক দু দিন পরে অগাস্ট মাসের প্রথম দিকে আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় বড় করে আমাদের ছবি দিয়ে দেবদূত ঘোষ ঠাকুরের লেখা বেরিয়েছিল। আমি তখনও দেবদূত দাকে চিনতাম না। সেই দিনই দশটার পর থেকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া আসতে শুরু করলো এবং আমাদের ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করল । সেদিন বোধহয় পাঁচটার পরে লাঞ্চ খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এরপর পড়লাম আরেক বিপদে! কাজটার accuracy লেভেল এতটাই হয়েছিল যে ক্লাবের একটা ছেলে ছবিগুলোর সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেলাতে শুরু করলো যেটা একটু বিরক্তির কারণ হয়েছিল । একদিন যেদিন আমি শিলিং এ মডেল সেট করছি সেই দিন দেখি নীচে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক নিবিষ্ট দৃষ্টিতে আমাদের কাজ দেখছেন। নীচে নেমে জানতে পারলাম উনিই শ্রী দেবদূত ঘোষ ঠাকুর। প্রায় প্রতিদিনই আসতেন সকলের অজান্তে। যাই হোক তারপর তো ইতিহাস। ষষ্ঠীর দিন তো পুলিশ মণ্ডপে ঢোকাই বন্ধ করে দিয়েছিল! সেই সময় তখনকার বিরোধী দল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি র সৌজন্যে দর্শনার্থীরা মণ্ডপ ভালো ভাবে দেখতে পেয়েছিল। এর থেকেও আমার একটা বড় প্রাপ্তি ঘটেছিল! একটা বাচ্চা ৫ বছরের মেয়ে টুক টুক করে হেঁটে এসে যখন তার ভাগের একটা চকোলেট আমার হাতে দিয়ে বলেছিল ‘কাকু তুমি এটা খাও’।  আরো একটা কথা— সেই সময় ‘ঢাকুরিয়া নস্কর পাড়া সার্বজনীন’ এর ৫০ বছরের কাজটা আমাকে করতে হয়েছিল। তাতে করেছিলাম ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’। কাজটা ভাল হলেও কি হবে ঐ যে আছে না ‘বাতজ বেদনার’ মূল কারণ রক্তের শ্বেতকণিকা ই অন্য শ্বেতকণিকা গুলোকে ভক্ষণ করে। ঠিক সেইভাবে ‘আমাদের’ তৈরি দিলওয়ারা টেম্পল ‘আমাদেরই’ তৈরি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে খেয়ে নিয়েছিল। তাই তার প্রচার খুব একটা হয়নি।

Share