শিল্পীর পুজোনামচা/৮

বদলে গেল ঘরানাটা

দীপক ঘোষ

২০০৪ সালের শেষের দিকে জাহাজে কর্মরত যোধপুর পার্ক শারদীয়া কমিটির কর্ণধার আশিস মুখার্জী ভারতে ফিরে এসে আবার আমাকে আর আমার ডেকোরেটর আত্মীয়কে ডেকে পাঠালেন ওনাদের হয়ে একত্রে কাজ করার জন্য। দাদা বলে সম্বোধন করি তাই আশিসদা কে ফেরাতে পারলাম না রাজি হয়ে গেলাম ওদের হয়ে কাজ করে দেবো বলে। তখন যেহেতু আমরা যে যার কাজ করি আলাদা আলাদা ভাবে, তাই মাঝে সম্পর্কটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ভুবনেশ্বরে মুক্তেশ্বর টেম্পল বলে যে মন্দির কমপ্লেক্স টা আছে সেটার ছবি দেখে আমার মনে হয়েছিল যোধপুর পার্কের মাঠে ওই মন্দিরটা ভালো মানাবে তাই সেই রঘু’দা কে (যে আমার সঙ্গে দিলওয়ারা টেম্পল বানিয়ে ছিল) সঙ্গে নিয়ে আমি আর আমার সেই আত্মীয়র পরিবার সমেত ভুবনেশ্বরে চলে গেলাম মন্দিরটা ভালো করে দেখে আসতে। একদিনে তো ভালো করে দেখে আসা যায় না, তাই ঠিক করলাম সময় করে আবার আসব। শুধু স্ট্রাকচারাল পার্টটা কিভাবে হবে সেটাই রঘুদাকে বোঝালাম। যোধপুরের সোনা (মানে সুমন্ত রায়) প্রতিবছরই অন্তত দুই থেকে তিনবার পুরীতে যায়। তাই ওকে বলেছিলাম ও যেন মন্দিরটা দেখে আসে আর পারলে কিছু ছবিও তুলে আনে। ও দেখেছিল, কিন্তু ওর ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি। এবার পালা ওই মন্ডপ করতে কত খরচা হবে তা জানা। শতাংশে ভাগ করলে দেখা যাবে কারুকাজ ৮০% আর স্ট্রাকচারাল কাজ ২০ %। ৮০% কারুকার্যের জন্য আমি যে দাম বলেছিলাম সেই ডেকোরেটর ২০% কাজের জন্য তার থেকে বেশি বলেছিল। তারপর মন্দিরটা দেখে এসে সোনা তাকে বলেছিল আসল কাজটা দীপকদার আর তুমি চাইছো দীপক দার থেকেও বেশি? তখন সোনা এমন একটা অ্যামাউন্ট বলে যেটা মোটামুটি ঠিক ছিল (পুজো করতে করতে ওতো একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল)। এর পরেই ডেকোরেটরের সেই পেটুয়া লোকটি ( যে নাকি পুতুল নাচের ইতিকথার সময়  আমাকে বিরক্ত করেছিল) আমাকে বলে ওঠে ‘দীপক তোমাকে যোধপুর পার্কে কাজ করতে দেওয়া হবে যদি তুমি ফিফটি পার্সেন্ট কম করো।’ ‘করতে দেওয়া হবে’ কথাটা আমি ঠিক হজম করতে পারিনি। আমি তো যেচে যাইনি! কোথাও যাই  ও না। তাই আশিসদার কাছে বিদায় জানিয়ে চলে এসেছিলাম। মুক্তেশ্বর মন্দিরটা আমার এতটাই ভাল লেগেছিল যে আমি আবার ওই মন্দিরের পুরোটাই করায়ত্ত করার জন্য তৎকালীন আমার এক সঙ্গীকে নিয়ে ৫ দিনের জন্য ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলাম। আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে পারমিশন নিয়ে মন্দিরের মাপঝোক ও তার ইতিহাস জেনে এসেছিলাম।খুব শখ হয়েছিল যদি সঠিক জায়গা পাই এই মন্দিরটা ২০০৫ এই বানাবো।
২০০৫ এর ফেব্রুয়ারি মাসে ফোন এল অরূপের কাছ থেকে, ‘দাদা এবার কি করবে?’ আমি বললাম ‘উড়িষ্যার মুক্তেশ্বর টেম্পল টা বানাবার ইচ্ছে।’ অরূপ বলল, ‘দাদা দু বছর আগেই আমরা উড়িষ্যা রাজ্য নিয়ে কাজ করেছি তাই তুমি অন্য কোন স্টেট ভাবো।’ আমি বললাম ‘আমার যে খুব সাধ হয়েছে এই মন্দিরটা বানানোর তাই এবার তুমি অন্য কোনও শিল্পীকে দিয়ে অন্য কোনও রাজ্য বানাও। এখনও তো সময় আছে। আমি ঠিক জায়গা পেয়ে যাব।’ ভগবানের কি অদ্ভুত লীলা! পরেরদিনই মুদিয়ালি ক্লাব এর সেক্রেটারি শানুদা আমাকে বললেন ‘দীপকদা এবার আমাদের মুদিয়ালিতে কাজ করে দেবেন?’ মুদিয়ালির জায়গাটা তো আমার দেখা, আর ওটা ওখানে করা সম্ভব । তাই বললাম, ‘করতে পারি তবে আপনাদের চিরাচরিত দুর্গা ও তার সাজ বদলাতে হবে কারণ এখন থিমের যুগ সব কিছু র সামঞ্জস্য থাকলেই কাজটা উতরে যাবে।’ ওরা রাজি হয়ে গেল। আমরাও মন্দির বানাতে শুরু করলাম। ঠাকুরটা বানাবে প্রদীপ রুদ্র পাল উড়িষ্যার মূর্তি তৈরীর ঘরানাকে মাথায় রেখে। দু-একজন বাদ দিলে মুদিয়ালি পরিবারের সকলেই ভালো বিশেষ করে শাউ পরিবার। থিম মানে তো সব দিকেই নজর রাখতে হয় তাই খরচটা একটু বেশি হয়। গত দু’বছর মুদিয়ালি কাজের মান সেরকম না হওয়াতে ওদের মেইন স্পন্সর হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তাই শানু দা’রা একটু চিন্তিত ছিল। ভগবান বোধ হয় আমার মুখ দিয়েই বলে দিয়েছিল, ‘এবার যে কাজ হবে তার ফলে তোমাদের আর পিছিয়ে থাকতে হবে না। স্পন্সররা দলে দলে আসবে।’ পুজো যতই এগিয়ে এলো মেইন স্পন্সর বাদ দিয়ে অন্যান্য বেশকিছু ফিনানসিয়াল সাপোর্ট জুড়ে গিয়েছিল। তাই সে যাত্রায় মুদিয়ালি বেঁচে যায়। কারণ, ওদের ইতিহাসে নেই কেউ কোনদিন ওদের কাছ থেকে এক পয়সাও পাবে। কাজটা অসাধারণ হয়েছিল (লোকে বলে ছিল)। সুরুচি সংঘের মত এখানেও কোন ডেকোরেটরকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করিনি, সমস্ত মাল কিনে কাজ করেছি। শুনেছিলাম ২০০৬ সালে ওদের স্পনসরদের মধ্যে খুব রেষারেষি হয়েছিল কে কোন জায়গাটা নেবে।

Share