নেতার পুজোয় হাতে খড়ি
দীপক ঘোষ
২০০৩ সালে যোধপুর পার্কের পুজোর পর অপেক্ষা করছিলাম বড় কোনও জায়গায় পুজোর ডাক আসে কিনা তার জন্য। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে একদিন সন্ধ্যেবেলায় হঠাৎই আমার মোবাইলে ফোন আসে দেবদূতদার। উনি ফোনে আমাকে বলেন ‘দীপক দা আপনার কাছে সুরুচি সংঘের অরূপ বিশ্বাস আসতে পারে অবশ্য আসার আগে ও আপনাকে ফোন করে নেবে।’ আমিতো অবাক! এ তো মেঘ না চাইতে জল! দুদিন পরে রাত্রি আটটা নাগাদ আমার বাড়িতে কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই দেখি এক সুদর্শন যুবক হাতজোড় করে বলে উঠলো ‘আমি অরূপ বিশ্বাস, সুরুচি সংঘের পূজো করি। আপনি কি আমাদের টা করে দেবেন?’ আমি বলি আগে তো ভেতরে আসুন, তারপর নয় কথা বলা যাবে। ও সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো, ‘দীপক দা আমি তোমার থেকে ছোট আমাকে দয়া করে আপনি বোলো না, আমাকে নিজের ছোট ভাই ভাবো।’ এই সরলতা প্রথমেই আমাকে ওর নিজের করে ছাড়লো। আগেই বলেছিলাম পুজোর কাজ করার পর আমার কোন কিছুই দেখা হয় না, তাই সুরুচি সংঘের জায়গাটা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি। ও তো পারলে তখনি আমায় নিয়ে যায়। দু’দিন পর সুরুচি সংঘের জায়গাটা দেখে এসে ঠিক করি সেখানে কি করব। তখন সুরুচি সংঘের ট্রেন্ড চলছিল তারা প্রতিবারই কোনও না কোনও স্টেট বা রাজ্য তৈরি করে। আমি তখন ‘রাজস্থান’ করার কথা বলি। ও এক কথায় রাজি হয়ে যায়। তারপর থেকে ও মানে অরূপ বিশ্বাস রোজ ফোন করতো ‘দাদা কি করবে ঠিক করলে?’ একদিন অরূপকে আমার বাড়িতে আবার ডাকলাম। ও আমার বাড়িতে এসে প্রথমেই রান্নাঘরে গিয়ে বসে আমার বউকে বলল, ‘বৌদি ভালো করে মুড়ি মাখো আমি খাব।’ ওর এই আপন করে নেবার ক্ষমতা আমাদের সকলকে মুগ্ধ করেছিল, যতই হোক সে তো একজন নেতা ও কাউন্সিলর। তখন আমি তাকে জয়সলমীর এর কিছু সূক্ষ্ম কাজের ছবি দেখাই আর ওর সঙ্গে রাজস্থানী ফোক ডান্স ও গানের সংগঠনের কথা জানাই। ও বলে, ‘দাদা এটা দারুন হবে। আমি কালকে আমার ক্লাবের আরও কয়েকজনকে নিয়ে আসব।’ পরের দিন আবার সেই আটটা নাগাদ ও সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে এলো আমার বাড়িতে। ও যাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল তাঁর হাবভাব দেখে আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম, বোধহয় খুব বড় মাপের শিল্পী হবে! ও অল্প কথা বলে নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখলো। অরূপ যখন তাকে জিজ্ঞাসা করল জিনিসটা কেমন হবে? ও গম্ভীর গলায় বললো ‘যা দেখালো ঠিক সেরকম যদি হয় ব্যাপারটা ভালোই হবে।’ আমার সঙ্গে কিন্তু একটা কথাও সে বলেনি তখন। পরে যখন কাজ শুরু করি ও মাঝে মধ্যেই আমাদের কাজের জায়গায় আসতো। ভালো কথা, অরূপ আমাদের একটা ভালো কাজের জায়গা দিয়েছিল যা সচরাচর কোনো পুজো কমিটির কাছ থেকেই পাইনি। তাই আমার সুবিধা হতো স্ট্রাকচারাল কাজ ও ডিজাইনের কাজ কে সমতালে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ভাবলে অবাক হবেন সেই গুরুগম্ভীর লোকটি (আমার বয়সেরই কাছাকাছি) তারপর কেমন যেন আমার ন্যাওটা হয়ে গেল। দীপকদা অন্ত প্রাণ। অরূপকে যেভাবে পেমেন্ট সিডিউল করে দিয়েছিলাম, ও কিন্তু ঠিক সেইভাবেই আমাকে অর্থের যোগান দিয়েছিল বিন্দুমাত্র কাজের অসুবিধা হয়নি। অরূপ আমার ওপরে এতটাই নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল যে- কোনও কাজে হস্তক্ষেপ পর্যন্ত করেনি তাই আমিও মনের সুখে কাজ করে চলেছিলাম। থিমের নাম ছিল ‘রাজ ভূমি রাজস্থান’। সেখানে জয়সলমীর সূক্ষ্ম কারুকাজ সমেত একটা কাল্পনিক মন্দির বানাই এবং তার সমগ্র প্রাচীরটা করি জয়সলমীরের কেল্লার প্রাচীরের মতো ভেতরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজস্থান সম্বন্ধীয় আঁকা গুলি সেই প্রাচীরের ভেতরে ডিসপ্লে করি গেটের মুখেই রাখি ঘোড়ার উপরে মহারানা প্রতাপ সিং এর মূর্তি, মন্দিরের ডান পাশেই রাখি নৃত্যমঞ্চ,বালি, উট প্রভৃতি। সেই প্রথম পিনাকী গুহ দুর্গাপূজার আঙিনায় আসেন আলোর যাদু দেখাতে। রাণাপ্রতাপের মূর্তি বাবলু বণিক ও আর একটা ছেলে তৈরী করে। প্রতিমা বানিয়েছিল প্রখ্যাত ভাস্কর শ্রী প্রদীপ রুদ্র পাল ‘রাজস্থানী মিনিয়েচার পেইন্টিং’ এর ধারনাকে অবলম্বন করে। যতই দিন যায় ততই অরূপের মাঠে থাকার সময়টা বাড়তে থাকে। ও তখন এতটাই ছেলে মানুষ ছিল যে দুটো পা ফুলে যাওয়া সত্ত্বেও তিন রাত্রি ঠায় জেগে পুজো মণ্ডপে বসে থাকতো পুরস্কার দাতাদের অপেক্ষায়।ওর বাবাও যদি ওঁর বন্ধুকে এনে সহজ পথে ঠাকুর দেখাবার চেষ্টা করত তাও অরূপ রুখে দিত। আমি বলতাম আরে উনি তো তোমার বাবা! বাবাকে তো অন্তত ছাড় দাও। ওর কথা, ‘না দীপক দা এখানে বাবা’ আত্মীয়, বা বন্ধুর কোন স্থান নেই ,আমাকে একটা নিয়মের মধ্যে রাখতে হবে। না হলে সবাই বলবে এটা অরূপের পুজো তাই অরূপ যা খুশি করছে।’ কথাটা শুনে ভালো লেগেছিল। যখন কাজ চলছিল তখন এক দুপুর বেলায় এসে আমায় বলল, ‘দীপক দা চলো লাঞ্চ করে আসি।’ আমি বললাম, ‘আমি আমার কাঠের মিস্ত্রীর সঙ্গেই খাব।’ যা শুনে ও খুব অবাক হয়ে গেছিল। আমি বললাম ‘জানোতো স্টুডেন্টরা যে টিচার কে ভালোবাসে, তার সাবজেক্ট তারা ভালো করে পড়াশোনা করে। তাই আমি যদি ওদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখি ওদের কাজটাও কিন্তু দায়সারা হয়ে যাবে।’ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল বলল, ‘দীপকদা এতদিন এত শিল্পী কাজ করেছে এই কথা কাউকে বলতে শুনিনি। আর এই যে তুমি কাজ করছ আমাদের কারোর এক মিনিটের জন্যও দুশ্চিন্তা হয়নি। তুমি নিরবে কাজ করে যাচ্ছে আর কাজ উঠে যাচ্ছে।’ আমি বললাম, ‘আমাকেইতো দায়িত্বটা দিয়েছো নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য। তাহলে তোমাদের কেন আমি দুশ্চিন্তায় ফেলবো।’ হ্যাঁ তবে একটা কথা, যেটা ওর এগেনস্টে যায়,সেটা হচ্ছে পুজোর সাত দিন বাকি থাকা পর্যন্ত ভাবনা থেকে শুরু করে সবকিছুই ওর নাম নিয়ে চলে ! পুজোর ঠিক সাত দিন আগে শিল্পীর নাম মন্ডপের চৌহদ্দিতে টানিয়ে রাখে!! তখন তো এত ফেসবুকের রমরমা ছিল না তাই অধিকাংশই দর্শকরা জানতে পারত না ‘মূল শিল্পী’ কে বা কার ভাবনা প্রসূত এই উপস্থাপন। সেইবার এশিয়ান পেইন্টস বাদে সব পুরস্কারই বোধহয় ওর ঝুলিতে এসে গিয়েছিল প্রতিমার ক্ষেত্রে ভক্তিভাব এর অভাব থাকায় এশিয়ান পেইন্টস পেল না, যদিও বা সেইবার আমি কিন্তু সম্পূর্ণ অনুকরণ কিছুই করিনি। রাজস্থানী আঙ্গিক টাকে ঠিক রেখে সূক্ষ্ম কারুকাজ গুলি আমার প্রধান হাতিয়ার ছিল।