দেবদূত ঘোষঠাকুর
মহালয়ার দিনটি কি?
খুব সাদামাটা ব্যাখ্যা একটা আছে। পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ। কেউ আবার বলেন, অশুভ সময় থেকে শুভ সময়ে পদার্পন। কারণ, পিতৃপক্ষের কোনও শুভ কাজ করা যায়না। তাই এই সময়কালে নতুন কিছু শুরু না করতে বলেন অনেকে। এমনকী যদি কোনও সুসংবাদ পাওয়া যায়, তবে তা পিতৃপক্ষের পরে করা উচিত।।
মহালয়ার আগের ১৫ দিনকেই পিতৃপক্ষ বলে।
কেউ কেউ বলেন, এই সময় নতুন কিছু কেনা উচিত নয়। কিন্তু কি আশ্চর্য এই পক্ষকালেই পুজোর জামাকাপড় কেনার ধূম পড়ে। পটুয়াপাড়ায় প্রতিমার ফাইনাল টাচ দেওয়া হয় ঠিক এই সময়েই। অনেকে মন্ডপে প্রতিমা এনে এই সময়েই একসঙ্গে মন্ডপ আর ঠাকুরের চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়। শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব পিছনেই থেকে যায়।
পঞ্জিকা মতে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদে পিতৃপক্ষ শুরু হয়। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী ভাদ্র পূর্ণিমা তিথিতে পিতৃপক্ষ শুরু হয়। শেষ হয় মহালয়ার দিন। ওই দিন থেকেই আবার শুরু হয় নবরাত্রি। নবরাত্রির উৎসব সব থেকে জাঁকজমকপূর্ণ হয় গুজরাতে। এখানে দশ দিন ধরে উৎসব চলে। মা অম্বা ও মা আশাপুরার পূজা হয় খুব জাঁকজমক করে। এর সঙ্গে বসে গরবা নাচের আসর।
এ বছর পিতৃপক্ষ শুরু হয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর। চলবে ৫ অক্টোবর। ৬ অক্টোবর মহালয়ার দিন থেকে মাতৃপক্ষ বা দেবীপক্ষের শুরু। শুরু নবরাত্রির পুজোও।
এক পুরোহিত বলছিলেন, পিতৃপক্ষের সময়ে শুদ্ধ থাকতে হয় মানুষকে। না হলে নাকি পূর্বপুরুষরা রেগে যান। তাঁরা চান, এই সময়টায় তাঁদের উত্তরপুরুষেরা শ্রাদ্ধ করুক। তাহলে তাঁদের আত্মা মুক্তি লাভ করেন। পুরাণ বলছে, পিতৃ পক্ষের আচারের সময় যে কোনও ভুল-ত্রুটি পূর্বপুরুষদের ক্রুদ্ধ করতে পারে। যা পিতৃ দোষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই কিছু কাজ এড়িয়ে চলাই ভাল।
কি কি কাজ? পন্ডিতেরা কেউ কেউ বলছেন, পিতৃ পক্ষের সময়, আমিষ খাবার এবং পেঁয়াজ-রসুন চলবে না। কোনও উৎসব পালন করা চলবে না। নখ, চুল- দাড়ি কাটা যাবেনা। এই সময়কালে শারীরিক সম্পর্কও করা যাবে না। অপবিত্রতা পূর্বপুরুষদের কিন্তু অসন্তুষ্ট করতে পারে। এই সময়ে কোনও শুভ কাজ না করার নিদান থাকলেও, দান করা চলতে পারে বলে পন্ডিতদের অনেকে মনে করেন। এই সব নিয়ম পালন করলে নাকি পিতৃদোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু দান করাটা শুভ না অশুভ কাজ সেই ব্যাখ্যা নেই। অর্থাৎ এখানেও একটা দ্বন্দ্ব।
পুরাণ বলছে, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। তাই কেবলমাত্র পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধ করতে হয়।
পন্ডিতেরা অনেকে বলেন, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ শুরু হয়। এই সময় নাকি পূর্বপুরুষগণ তাদের উত্তরপুরুষদের বাড়িতে চলে আসেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশে তর্পণ করতে হয়।
মহাভারতে নাকি বলা আছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে যান। স্বর্গে তাঁকে নাকি খাবার হিসেবে সোনা ও রত্ন দেওয়া হয়। কেন তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ করা হচ্ছে তা ইন্দ্রের কাছে কর্ণ জানতে চান।
ইন্দ্র বলেন, ‘আপনি সারা জীবন সোনাই দান করেছেন। পিতৃ পুরুষদের কখনও অন্ন জল করেননি। তাই স্বর্গে আপনাকে সোনাই খাবার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।’ কর্ণ জবাব দেন, ‘আমার পিতৃপুরুষের পরিচয়ই তো আমি জানতাম না। তাই যা করেছি তার অনিচ্ছাকৃত ভুল।’ তখন নাকি ইন্দ্র ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে কর্ণকে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্য অন্ন ও জল দেওয়ার করার অনুমতি দেন। এই ষ পক্ষ কালই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত।
প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা – এই নিয়ে পিতৃপক্ষ। এর মধ্যে যে তিথিতে বাবার মৃত্যু হয়, সেই তিথিতেই তর্পণ করতে হয় বলে পন্ডিতেরা অনেকে বলে থাকেন। পিতৃপক্ষে পুত্রের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশাধিকার পান। গরুড় পুরাণের উল্লেখ করে এক পন্ডিত বলেন, পুত্র ছাড়া মুক্তি নেই। সেখানে গৃহস্থদের দেব, ভূত ও অতিথিদের সঙ্গে পিতৃতর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের উল্লেখ করে ওই পন্ডিত বলেন, পিতৃ পুরুষেরা শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।
কিন্তু যাঁরা অকৃতদার কিংবা যে সব পিতার পুত্র সন্তান নেই, যাঁরা নিঃসন্তান তাঁদের আত্মার কি হবে? হিন্দুধর্ম অনুযায়ী, মৃত পূর্বপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে কেউ তর্পণ করতে পারেন। সাধারণত পুরুষরাই পিণ্ডদান করলেও মহিলারাও কিন্তু সমান ভাবে পিণ্ডদানের অধিকারী। পুরাণে আছে সীতা দশরথের মৃত্যুর পর রামের অনুপস্থিতিতে তাঁকে পিণ্ডদান করেছিলেন।
অর্থাৎ ‘অক্ষয়’ স্বর্গবাসের সব পথই নিশ্চিত করেছে হিন্দুশাস্ত্র।