দশমী

দেবদূত ঘোষঠাকুর

সেসব কী দিন ছিল!

শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা বেরোবে। চারিদিকে হইহই রব। রাস্তার দুইধারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ। বাজনার আওয়াজ। অস্ত্রের ঝনঝনাৎ। মোটবাহকদের হাঁকাহাঁকি। এক-আধজন নয়, শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুর বিসর্জন দিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার হত ৩২ থেকে ৪০ জন বাহক।

শোভাবাজার রাজবাড়ির বিসর্জনের শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ ছিল, বাড়ি থেকে প্রতিমা বের হওয়ার সময়ে উত্তরের আকাশে ছেড়ে দেওয়া হত দু’টি নীলকণ্ঠ পাখি। প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী— উত্তরের আকাশে নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়ার অর্থ, ওই পাখি নাকি উড়ে যাবে কৈলাসে। শিবকে খব‍র দেবে যে, পার্বতী বাপের বাড়ি থেকে সপুত্রকন্যা কৈলাসের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।

অন্য পাখি থাকতে নীলকণ্ঠ কেন? অনেকেই বলেন, নীলকণ্ঠ শিবের আরেক নাম। সমুদ্রমন্থনের পর ওঠা ভয়ানক বিষের প্রভাব থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করতে সেই বিষ নিজের কণ্ঠে ধারণ করেন মহাদেব। বিষের জ্বালায় তাঁর গলা নীলবর্ণ ধারণ করে। তাই শিবের আরেক নাম নীলকণ্ঠ। এই নীলবর্ণের জন্য নীলকণ্ঠ পাখিকে শিবের দোসর বলে মনে করা হয় হিন্দুধর্মে। দশমীতে দুর্গাপ্রতিমার ভাসানের আগে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর প্রথা চালু হয় এই বিশ্বাস থেকে যে, নীলকণ্ঠ পাখি আগে কৈলাসে গিয়ে মহাদেবকে পার্বতীর আগমনবার্তা দেবে।

অনেকের মতে নীলকণ্ঠ পাখির দর্শনে পাপমুক্তি ও ইচ্ছাপূরণ হয়। বেশকিছু শহরে প্রচলন আছে খাঁচায় কাপড় ঢেকে পয়সার বিনিময়ে এই পাখি দর্শন করার। নীলকণ্ঠ পাখির ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান রোলার। আয়তন ২৫ সেন্টিমিটার থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার, লেজসমেত। ওজন ৭০–১০০ গ্রাম হয়।

শুধু শোভাবাজার রাজবাড়ি কেন? কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন বনেদি বাড়িতে দশমীর দিন নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল আগে। এই আচার মানতে গিয়ে প্রতি বছর বেঘোরে প্রাণ হারাত নীলকণ্ঠ পাখিরা। একটা খাঁচায় গাদাগাদি করে রাখা হত অনেকগুলি নীলকণ্ঠ পাখি। ফলে সেগুলি অসুস্থ হয়ে পড়ত। দশমীর দিন খাঁচা খুলে ছেড়ে দেওয়া হলেও, অধিকাংশ নীলকণ্ঠ শিবের কাছে পৌঁছতেই পারত না। একেই শহরের অনভ্যস্ত পরিবেশ, তার উপরে দীর্ঘদিনের বন্দিদশা। অসুস্থ পাখিগুলি ছাড়া পাওয়ার পর কিছুদূর গিয়েই পড়ে গিয়ে মারা যেত কিংবা অন্য শিকারী পাখির খাদ্য হত।

সেই রাম নেই, নেই সে অযোধ্যাও। দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির যেমন বদল হয়েছে, সেইসঙ্গে কড়া হয়েছে দেশের আইনকানুনও। এখন কোনও দেশীয় পাখি ধরে অন্তরীন করে রাখাটা আইনত দণ্ডনীয়।

তাই ১৯৭০–এর দশক থেকে দশমীতে নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো বন্ধ।

কিন্তু প্রথা মানতে এখনও দশমীতে উত্তর আকাশে ছাড়া হয় নীলকণ্ঠ পাখি। তবে জ্যান্ত নয়। এখন বেলুনে শোলার তৈরি নীলকণ্ঠ বসিয়ে উত্তরদিকে মুখ করে সেই বেলুন ছেড়ে দেয় শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফ। আর মাটির নীলকণ্ঠ পাখি তৈরি করে দেবীর সঙ্গেই সেগুলির পুজো করে ছোটতরফ। তারপর গঙ্গায় গিয়ে বিসর্জন দেয়।

সেইসঙ্গেই বাড়ি থেকে বেরনোর সময়ে এবং পরে দুটি নীলকণ্ঠ পাখি আঁকা ফানুস ছাড়ে। এরপর মাঝগঙ্গায় জোড়া-নৌকায় করে প্রতিমা নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।

***** *****

দশমীর দিন রাণী রাসমণির বাড়িতে সবার মন খারাপ। রাণীমার জামাই মথুরনাথের মুখ কালো। নিজেকে তিনি ঘরবন্দি করেছেন। মনের ব্যথা কারও কাছে প্রকাশ করতে পারছেন না। রাণীমা গত হয়েছেন। তাই জামাই মথুরনাথের মুখোমুখি হতে কেউ সাহস পাচ্ছেন না।

সেবার দশমী খুব কম সময় থাকায় নির্দিষ্টকালে দশমীবিহিত পুজো শেষ করে সন্ধ্যার পর হবে দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জন। বিকেলে পুরোহিতমশাই মথুরবাবুর কাছে বলে পাঠালেন, মায়ের বিসর্জন যাত্রার আর দেরি নেই, বাবু যেন নীচে নেমে এসে দুর্গা-বন্দনা ও প্রণাম করে যান। একদিকে দশভুজার মহাপুজোর অনির্বচনীয় আনন্দ, অপরদিকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কয়েকদিনের উপস্থিতিতে তাঁর সান্নিধ্যলাভ— এই অভাবনীয় আনন্দে বিহ্বল ও আত্মহারা মথুরমোহন সেদিন যে বিজয়ার বিসর্জন সেকথা অবলীলাক্রমে ভুলেই গিয়েছিলেন। পরে যখন বুঝে উঠলেন যে সেদিন বিজয়া দশমী, তখন নিরাশা আর মনোবেদনায় মুহ্যমান মথুরনাথ। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মাকে আর বিসর্জন দিয়ে দুঃখ ডেকে আনবেন না। রাজামশাইয়ের দু’চোখ বেয়ে নামে অবিরত অশ্রুর ঢল।

এদিকে বিসর্জনের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পুরোহিতমশাই বারবার লোক পাঠিয়েও বিফল। তখন মথুরবাবু অসন্তুষ্টিভরা গলায় বলে উঠলেন, ‘আমি মাকে বিসর্জন কিছুতেই দিতে দেব না। যেমন পুজো হচ্ছে তেমনই পুজো চলবে। আমার অননুমোদনে কেউ যদি প্রতিমা বিসর্জন দেয়, তাহলে সাংঘাতিক বিপত্তি দেখা দেবে, খুনোখুনি পর্যন্ত হতে পারে।’ এই বার্তা গিয়ে পৌঁছাল দুর্গাদালানে। বাড়িতে সম্মানীয়রা তখন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, সবাই এসে গৃহকর্তাকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।

মথুরনাথের এক গোঁ, “কেন? আমি মা’র নিত্যপুজো করব। মা’র কৃপায় আমার যখন সে ক্ষমতা আছে, তাহলে বিসর্জনই বা দেব কেন?”

কোনও অনর্থ ঘটে যাওয়ার আগেই মথুর-গৃহিণী জগদম্বাদেবী ঠাকুর রামকৃষ্ণের শরণাগত হলেন। ঠাকুর এলেন। দেখলেন। মথুরনাথের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মথুরনাথের চোখের জল যেন বাধা মানে না। কেন তিনি ভিতরে ভিতরে এত পীড়া অনুভব করছেন, কীসের জন্য তাঁর এমন বিহ্বল অবস্থা তা ঠাকুরকে জানালেন— “প্রাণ থাকতে দেবী দুর্গামাকে বিসর্জন দিতে পারব না।” মাকে কি কেউ বিসর্জন দিতে পারে? মথুরনাথের মূল প্রশ্নটা ছিল সেখানেই।

ঠাকুর হেসে বললেন, “ওঃ! এই তোমার ভয়? তা মাকে ছেড়ে তোমায় থাকতে হবে কে বললে? আর বিসর্জন দিলেই বা তিনি যাবেন কোথায়? ছেলেকে ছেড়ে মা কি কখনও থাকতে পারে?”

মথুরবাবুর মন তবু শান্ত হতে চায় না। এবার ঠাকুর যা বললেন, ভক্তি ও শাস্ত্রবিধির বিরোধে বিসর্জনের তাৎপর্যার্থে তা স্মরণীয়। ঠাকুর বললেন, “এ তিনদিন বাইরে দালানে বসে তোমার পূজা নিয়েছেন, আজ থেকে তোমার আরও নিকটে থেকে— সর্বদা তোমার হৃদয়ে বসে তোমার পূজা নেবেন। মাকে বিসর্জন দেবে কোথায়? বিসর্জন দেবে নিজের হৃদয়ে।”

এরপরে মথুরনাথ রাজি হলেন। প্রতিমা বিসর্জনের কাজ সুসম্পন্ন হল।

কৃতজ্ঞতা : স্বামী সারদানন্দের রচনাবলী

Share