শিল্পীর পুজোনামচা/১

খুঁটি পুজোর খুটিনাটি

দীপক ঘোষ

এখন প্রায় সারা বাংলার বারোয়ারির পুজোতে (তা দুর্গাপূজা হোক বা যে কোনও মূর্তি পুজো) খুঁটি পুজো ও একটা প্রারম্ভিক উৎসবে পরিণত হয়েছে! মানুষ একটু আনন্দ খুঁজে নিতে সদাই তৎপর। এতে দোষ দেখি না। সাধারণের কাছে এই খুঁটি পুজোর উপাদান হ’লো – একটি বিশেষ ছুটির দিন (যা আশ্বিন থেকে পিছিয়ে আসতে আসতে ১লা বৈশাখে এসে পরেছে,তবে ২০২০ আর ২০২১ একটু বাধ সেধেছে); এছাড়া একটা সুসজ্জিত বাঁশ বা ইউক্যালিপ্টাস খুঁটি, একটি ফুলের মালা, কিছু কুঁচো ফুল, বেলপাতা, দূর্বা, তুলশী পাতা, নারকেল, ধূপ-ধুনো, গঙ্গার জল ও একজন ব্রাহ্মণ যার বৃত্তি পুরোহিতগিরি। সঙ্গে ক্যামেরা সহ প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রির্পোটার এর অত্যাবশ্যকীয় উপস্থিতি, কারণ কোনো না কোনো নেতা বা অভিনেতার (জুতো পড়া অবস্থাতেই) ঐ খুঁটি ধরে থাকা ছবি তুলতে হবে তাঁদেরকে এবং পরের দিন (অনামী ক্লাবের ক্ষেত্রে আরও দুই-তিন দিন পরে) খবরের কাগজে ছবি সহ ছাপা অক্ষরে মুদ্রিত হতেই হবে, সঙ্গে প্রভাবশালী নেতা, অভিনেতা ও শিল্পী নাম্নী ব্যাক্তির সাখ্যাৎকার টেলিকাস্ট করতে হবে, তবে এ সবের জন্য একটা ভুঁড়ি ভোজের আয়োজন ও থাকে।– এই হলো সাধারণ অর্থে খুঁটি পুজো! আবার শোনা যায় এই খুঁটি পুজো নিয়ে প্রতিযোগিতাও নাকি বাজারে এসেছে!
খুঁটি পুজোর লড়াইয়ে বেচারা খুঁটির দুর্গতির শেষ নেই, কারণ- আনুষ্ঠানিক খুঁটি পুজোর অনেক দিন পর মণ্ডপ বাঁধার কাজ শুরু হয়, তাই প্রস্তাবিত মণ্ডপ প্রাঙ্গণে বেচারা খুঁটি শুকনো গাঁদাফুলের মালা ও কাকের বিষ্ঠা সর্বাঙ্গে লাগিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে। তাছাড়া বারোয়ারি পুজোতে যা যা পূজিত হয় তার মধ্যে ঘট ছাড়া সব কিছুই গঙ্গায়িত (বিসর্জন)
করা হয়।
এখন আমার প্রশ্ন- দুর্গা মূর্তি পূজিত হয় তাই তিনি গঙ্গায়িত হন, আপনাদের এই বিশেষ উৎসব অনুযায়ী খুঁটি ও পূজিত হয় , তাহলে সেই খুঁটি কেন গঙ্গায়িত না হয়ে ডেকরেটরের বাঁশের খাঁটালে স্থান পায়?
যাইহোক  এর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব কিন্তু অন্য কথা বলে। হিন্দু ধর্মে যে কোনো শুভ অনুষ্ঠান শুরু হয় কোনো না কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। যেমন বিবাহ ক্ষেত্রে প্রথমে আমন্ত্রিত হন গৃহলক্ষী ও মা গঙ্গা (যেই আচার কে ‘জল সইতে যাওয়া’ বলা হয়)। আবার গৃহারম্ভের আগে প্রস্তাবিত ভূমির বাস্তু পূজা করা হয় ‘বাস্তুরীতি’ মেনে। অনুরূপ পূজামণ্ডপ নির্মাণের সূচনাতেও ‘ভূমি পুজো’ করা হয়ে থাকে বাস্তু শাস্ত্রীয় রীতি মেনে। বাস্তু ছক অনুযায়ী বাস্তুদেবের মস্তক থাকে ভূমির ঈশান কোণে। আর ঠিক সেই স্থানেই সঠিক বাস্তু মন্ত্রোচ্চারনের মাধ্যমে ভূমিকে পবিত্র বা শুদ্ধ করা হয় নারকেল ফাটিয়ে তার ভেতরের জল দিয়ে। কারণ নারকেলের জল হ’লো সত্ত্ব গুণের ধারক, আর নারকেলের শাঁস ও বাহিরের শক্ত খোলাটি  হ’লো যথাক্রমে রজো  ও তমো গুণের ধারক। তাই তমো ও রজো গুণকে বিসর্জন দিয়ে সত্ত্ব গুণ দিয়ে ভূমিকে শুদ্ধ করা হয়। যতদূর জানি ঋষি-মুনিরা খুঁটি নিয়ে কোনও মন্ত্র লিখে যাননি (তাই তা পুরোহিত দর্পণে লেখা নেই)। সেই কারণেই বোধহয় ‘খুঁটি পুজো’ শব্দটি বেমানান ও নিরর্থক।
তা সত্বেও যদি এই অনুষ্ঠান কে একটু অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে এর একটা প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাওয়া যায়।  আমরা এই খুঁটি পুজো করি কেন? ঐ স্থানে ‘মা দুর্গা ‘ কে আবাহন কোরবো বলেই তো! একটু খেয়াল করলে দেখা যায় ন্যায়াধীশ  ন্যায়ালয়ে প্রবেশ করার আগের সাংকেতিক চিহ্ন ন্যায়দণ্ডের প্রবেশ হয়; রাজসভায় রাজার আসন্ন উপস্থিতি জানান দেয় প্রথমে রাজদণ্ডের প্রবেশ। অনুরূপে দেবতার (ধর্মের অধীশ্বর বা অধীশ্বরীর) প্রবেশের আগে আসে “ধর্ম ধ্বজা দণ্ড”।
তাই আধ্যাত্মিক চেতনা অনুযায়ী এই প্রচলিত লৌকিক শব্দ “খুঁটি পূজা”র আসল শব্দবন্ধ হলো “বাস্তু পূজা ও ধর্ম ধ্বজা দণ্ডের অভিষেক।”
আমার কাছে এই ‘খুঁটি পুজো’ শব্দটি অনেকটা এইরকম – পরমেশ্বরী র ডাক নাম – ‘পুঁটি’!!! (চলবে)

Share