পুজোর ভগীরথ

দেবদূত ঘোষঠাকুর

ঠাকুমা বলতেন, আমাদের সনাতন ধর্মের নিয়ম হল যে কোনও শুভ কাজের সময়ে পিতৃপুরুষকে স্মররণ করে তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করা। বিয়ে, অন্নপ্রাশন সব ক্ষেত্রেই তাই তর্পনের প্রথা চালু আছে। শ্রীরামচন্দ্র সেটাই করেছিলেন। পিতৃপক্ষ কোনও শুভ কাজের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই রামচন্দ্র দেবী দুর্গাকে আহ্বান করার জন্য অপেক্ষা করেছেন পিতৃপক্ষের শেষ হওয়ার জন্য‌। দেবীপক্ষের সূচনায় বাহ্ম মুহূর্তে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শ্রীরামচন্দ্র। মহামায়াকে নিজের আলয়ে অর্থাৎ নিজের মধ্যে আমন্ত্রণ জানানোর এই প্রক্রিয়াই মহালয়া।
মহালয়া এই প।তথাপি আগে সীমিত অংশের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আপামর জনসাধারণের কোনও আগ্রহই ছিল না এই ধর্মীয় আচারের। কিছু হিন্দু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৩২ সালে আকাশবাণী প্রচারিত একটি অনুষ্ঠান রাতারাতি সর্বজনীন করে তুলল। যাঁরা ধর্মীয় আচার মেনে তর্পন করবেন, তাঁদের মতোই কাকভোরে উঠে রেডিওর সামনে বসাটা অভ্যাস করে ফেললেন। আর মে লোকটির কন্ঠের আকর্ষনে মানুষের এই উন্মাদনা তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
শুরুটা হয়েছিল ষষ্ঠীর দিনে। তারপর থেকে দিনটা এগিয়ে আসে। দেবীপক্ষের শুরুটাই হত মহিষাসুর মর্দিনী দিয়ে। ১৯৭৬ সাল ছাড়া এই কন্ঠস্বর কখনও মহালয়ার ভোরে মানুষকে বঞ্চিত করেনি। মহিষাসুর মর্দিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন সেই মানুষটি।
আসলে মাইক্রোফোনের প্রতি তাঁর ভালোবাসাই বীরেনবাবুকে অমর করে দিয়ে গেল।
কাল বৈশাখীর ঝড়ে এবং তার জেরে নামা প্রবল বৃষ্টিতে ভোর থেকেই অচল হয়ে গিয়েছে মহানগরী। বৃষ্টি আর থামতেই চায় না। ছিপছিপে চেহারার তরুণটি ছপছপ করে জল ভাঙতে ভাঙতে শ্যামবাজারের বাড়ি থেকে হাজির হয়ে গিয়েছেন অফিসে।
আর এসে থেকেই আকাশবাণীর ওই নতুন কর্মীটি বসে পড়েছেন মাইক্রোফোনের সামনে। মনে বড় সাধ ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাইক্রোফোনের সামনে বসে থাকার। তিনি মাইক্রোফোনে কথা বলবেন , আর তাঁর কন্ঠস্বর শুনবেন হাজার হাজার শ্রোতা। গলা শুনেই লোকে বলবে,’ইনি তো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।’
সেই কালবৈশাখীর সকালের বেশ কয়েকঘন্টা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর সেই স্বপ্নপূরণের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। অনুষ্ঠানসূচি তৈরি। কিন্তু নির্ধারিত শিল্পীরা যে কেউ আসেননি। অনুষ্ঠান চলবে কী করে? নিজে ঘোষণা করছেন, ‘তাহলে এখন একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যাক। ‘ কিন্তু গাইবে কে? শ্রোতারা অবাক হয়ে শুনলেন নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে গান ধরেছেন ঘোষক নিজেই। এভাবে ঘোষক নিজেই আবৃত্তি করলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গান, কবিতা চলল। এর পরে অন্য শিল্পী ও ঘোষক চলে আসায় ছাড়া পেলেন বীরেনবাবু। বছর কয়েক আগে আকাশবাণীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর (বর্তমানে প্রয়াত) মুখে এ সব গল্প শোনা।
ওই গল্প সূত্রেই জেনেছি, স্টুডিওর বাইরে এসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেখেন ঘর আলো করে বসে আছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বাণীকুমার (মহিষাসুর মর্দিনীর লেখক), প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (আকাশবাণীর পত্রিকা বেতার জগতের প্রতিষ্ঠাতা) আর রাইচাঁদ বড়াল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে আসতে দেখে পঙ্কজবাবুতো আপ্লূত, ‘একাই সব সামলে দিল একজন।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জবাব, ‘মাইক্রোফোনের টানেই তো ছুটে আসা।’
জীবনে ওই একটি বিষয়েই লোভ ছিল ওঁর, জানিয়েছেন বীরেনবাবুর প্রাক্তন ওই সহকর্মী।
শোনা যায়, ১৯৩১ সালে ওই ঝড়জলের দিনে চার মূর্তির আলাপচারিতা থেকেই মহিষাসুর মর্দিনীর পরিকল্পনার শুরু। পুজোর মুখে কী অনুষ্ঠান করলে তা নিয়ে নানা প্রস্তা উঠলেও তা মনঃপুত হচ্ছিল না কারও। সে বছর বসন্ত কালে অন্নপূর্ণা পুজো ও বাসন্তী পুজোর মাঝখানে দেবী বসন্তেশ্বরী নামে একটি অনুষ্ঠান ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। রাইচাঁদ বড়াল প্রস্তাব দেন, ‘দেবী বসন্তেশ্বরীর মতো কিছু একটা করলে কেমন হয়। পঙ্কজ মল্লিক আর বাণী কুমারের মনে ধরল সেই প্রস্তাব। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হল সুরের জগতে এক ঐতিহাসিক সৃষ্টির ।
দেবী বসন্তেশ্বরীতে চন্ডীপাঠ করেছিলেন বাণীকুমার নিজেই। কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনীর সৃষ্টি পর্বেই পঙ্কজ মল্লিক সরাসরি বাণীকুমারের মুখের উপরে জানিয়ে দিলেন, এবার যেটা করতে চলেছি সেখানে অন্য কেউ চন্ডীপাঠ করবেন। কারণ বাণীকুমারের গলা খাপ খাবে না। তাহলে কে করবেন চন্ডীপাঠ? পঙ্কজবাবু বেছে নিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে। তারপর যা হল সেটা একটা ইতিহাস।
মহিষাসুরমর্দিনীতে ভাষ্য পাঠ করে বাঙালীর হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকলেও, মাইক্রোফোন হাতে পেলে অসাধ্য সাধন করতে পারতেন তিনি।
আকাশবাণীর সঙ্গে বীরেনবাবুর পরিচয় কিন্তু নাটকের সূত্র ধরে। স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র তখন তিনি। একটি নাটকের দলের সদস্য তিনি। একদিন কয়েকজনকে নিয়ে গেলেন রেডিও দফতরে (তখনও আকালবাণী নামকরণ হয়নি)। বেতারে নাটক পরিবেশন করতে চান। আর্জি মঞ্জুর হল। তারপরে ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়লেন রেডিও আর মাইক্রোফোনের সঙ্গে। নাটকের পাশাপাশি ঘোষক। বিরূপাক্ষ ছদ্মনামে কৌতক নকশা লিখতেন। আর বিরূপাক্ষের ডাইরি নামে তা তরঙ্গায়িত হত। ছদ্মনাম বদলে বদলে তিনি পরিচালনা করেছেন মেয়েদের অনুষ্ঠান মহিলামহল আবার শ্রোতাদের চিঠির জবাব দিতে হত । কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর দিতেন তিনি। মাঝে মাঝে জবাবের সঙ্গে মিশিয়ে দিতেন রঙ্গ-রসিকতা।
তবে রঙ্গমঞ্চে অভিনীত গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শচীন্দ্র সেনগুপ্তের নাটকগুলিকে রেডিওর মাধ্যমে সম্প্রচারের ঝুঁকি নিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তাতে তিনি শতকরা একশভাগ সফল। এক প্রবীণ নাট্যশিল্পী একবার বলেছিলেন, অনেক নাটক রেডিওতেই ছিল বেশি জনপ্রিয়। রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত শিল্পীরা নাটক করতেন রেডিওতে। রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সেরা প্রযোজনা কি? ‘সেরা কী না জানি না, তবে আমার শোনা সেরা রেডিও নাটক হল দ্বিজেন্দ্রলালের চন্দ্রগুপ্ত,’ মন্তব্য ওই প্রবীণ শিল্পীর। ‘মাইক্রোফোনের সঙ্গে দোস্তি ছিল বীরেন ভদ্রের। ওঁর যে কোনও অনুষ্ঠান হাঁ করে শুনতাম। মনে হত, শ্রোতাদের সঙ্গে খেলা করছেন,’ তাঁর স্মৃতিকথায় এমনটাই লিখেছেন শিল্পী বিকাশ রায়।
মাইক্রোফোন হাতে অনর্গল কথা বলতে পারার দক্ষতা, কন্ঠস্বর উপরনীচ করে কথাকে খেলাতে পারতেন মানুষটি। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানও ছিল অগাধ। আকাশবাণীর এট প্রাক্তন।কর্তা এবার বলছিলেন, কোনও বিষয়ে একনাগারে কথা বলে যাওয়ার দক্ষতা শুধু নয়, শ্রোতাদের কী ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেডিওর সামনে বসিয়ে রাখা যাবে তার ফর্মূলা ছিল মস্তিষ্কে ঠাসা। এই জ্ঞানভান্ডারকে শানিত করতে পড়াশোনা করতে হত বীরেনদাকে। আর এর জন্য বাঙালী জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু।
রবীন্দ্রনাথ তখন গুরুতর অসুস্থ। রয়েছেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ করা যাবে কী না তা নিয়ে সংশয় বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যূ যেন হয় শান্তিনিকেতনে। শাল-পিয়ালের শান্ত পরিবেশে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি।
অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আকাশবাণী দফতরে ঘন ঘন ফোন আসছে। ১৯৪১ সালের ৭ অগস্ট সকালে স্টেশন ডিরেক্টরের নির্দেশ দিলেন, সকাল থেকে প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর কবির খবর শ্রোতাদের কাছে জানাতে হবে। নলিনীকান্ত সরকারকে রেখে দেওয়া হল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ফোন করে পাঠাতে থাকলেন পরিস্থিতি কতটা সঙ্কটজনক, কে কে এলেন, চিকিৎসক কি বলছেন-ইত্যাদি। আর স্টুডিওয় বসে সেই তথ্য শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন বীরেনবাবু। বাঙালীর কান তখন রেডিওতে। বেলা বারোটা তেরো মিনিটে চিকিৎসক ঘাষণা করলেন, বিশ্বকবি আর নেই। সেই দুঃসংবাদ বাঙালীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দেশ এল বিশ্বকবির শেষযাত্রা এবং নিমতলা শ্মশান থেকে গোটা অন্ত্যেষ্টি প্রক্রিয়ার রানিং কমেন্ট্রি শোনানি হবে। সকাল থেকে মাইক্রোফোনের সামনে বসে থাকা বীরেন্দ্রকৃষ্ণকেই দেওয়া হল। শ্রোতাদের সঙ্গে এমন আত্মীয়তা আর কারই বা ছিল!
কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির শেষযাত্রার ধারাবিবরণী রেডিয়োয় সেটাই প্রথম। আর ওই ধরনের অনুষ্ঠানে শ্রোতারা যে রেডিওর উপরে কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তা বুঝতে অসুবিধা হল না কর্তৃপক্ষের। এর পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায়ের শেষযাত্রার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।
একটা সময় বাঙালীর পুজো শুরুও হত বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে দিয়ে। শেষও তাই। মহিষাসুর মর্দিনী দিয়ে শুরু, ঠাকুর ভাষাণে শেষ। সে সময়টায় নিমতলাঘাট থেকে প্রতিমা নিরঞ্জনের ধারাবিরণী দিতেন তিনি ওই মানুষটি। এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বিসর্জনের লাইভ টেলিকাস্টের দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু শুরুটা আজও করেন সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই।
পুজোর ভগীরথ যে তিনিই।

Share