ভাস্করের চোখে/১

পরিবর্তনটা শুরু উত্তরেই

বিমল কুন্ডু

অশোকদা ওই সময়ে বিরাট বোর্ডের মধ্যে ঠাকুর তৈরি করতেন। মন্ডপ নয়, উনি শুধু ঠাকুর নিয়ে ভাবতেন। সেই পরিবর্তনটা তখন কিন্তু মানুষ গ্রহণ করেনি। অশোকদা প্রথমে ঠাকুর তৈরি করতেন শ্যামবাজার এভি স্কুলের উল্টোদিকে হেলথ কর্ণারের বাঁ দিকে গেটের সামনে একমাস আগে থেকে ঠাকুর গড়তেন। পরবর্তীকালে মাঠে হত। প্রায় ৫০ ফুট বাই ১০০ ফুট বোর্ডের মধ্যে উনি ঠাকুর গড়তেন। ওনার ঠাকুরের মধ্যে থিমটা বক্তব্যপূর্ণ ছিল। উনি খুব পড়াশোনা করে ঠাকুর করতেন এবং কমপ্লিটলি ওরিয়েন্টাল স্টাইলে। উনি যেহেতু সুনীল পালের ছাত্র ছিলেন, তাই তাঁর কাজের মধ্যে ইজিপশন থাকত, ইন্ডিয়ান ট্র্যাডিলনাল স্টাইল থাকত। দীপেন বসুর প্রভাব থাকত। নন্দলাল বসুর প্রভাব থাকত। এই যে কমপ্লিটলি ভারতীয় ধারায় যে কাজ এবং তার সঙ্গে ওনার ঠাকুরগুলো ম্যাক্সিমামটাই ইজিপশন। ঠাকুরগুলিতে কোনদিনও সিংহ করেন নি। থাকত বাঘ। এবং সেই বাঘের চারটে মাথা থাকত। এবং দুর্গা একেবারে দাঁড়িয়ে থাকত স্ট্রেট । ওনার অসুর ও দুর্গার মধ্যে একটা শুভ অশুভ দ্বন্দ্ব থাকত। সেটা মানুষের জীবনেও শুভ অশুভ ব্যাপারটা থাকে। তার মধ্যে সরস্বতী, লক্ষী এক একটা জায়গায়। যেমন আমার খুব মনে পড়ে কলকাতা উনিভারসিটির দ্বারভাঙা বিল্ডিং ভেঙে দেওয়া হল ওই বড় বড় থাম, সেই বছর উনি করেছিলেন সরস্বতী ঠাকুরের পায়ের নীচে পরে ছিল ওই বড় বড় থাম। এই যে সময়ের সাথে যে বক্তব্য তাতে থাকত প্রতিবাদী ঢং এবং অসাধারণ রঙের তার বৈচিত্র ছিল। তার ক্ষমতা অসামান্য ছিল এবং রং দিয়ে একটা জাগলারি করতে পারতেন। ওনার কাছে গেলে সে যেই হোক তাকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন যে আমি কি ভেবেছি, কি করেছি, কি করতে চাই। অশোক দা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। অশোক দা বলল, ‘আমি তো একজিবিশন করতে পারিনা , এটাই আমার একজিবিশন। ওনার ওখানে সবসময় দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্র সংগীত চলত। যে রুচিটা আমাদের ছেলেবেলা থেকেই উপভোগ করেছি। রবীন্দ্র সংগীত চলত, মাঠে যখন গান চলত তখন হিন্দিগান বা চটুল গান কিছুই চলত না। অত্যন্ত ভালো পরিবেশ তৈরি করতেন। মণ্ডপ থেকে ঠাকুর থেকে অত্যন্ত ভালো ডেকোরেশন হত। কিন্তু যারা রুচিবান লোক তারা সেইভাবে ওটাকে ফ্ল্যাশ করত না। পরবর্তীকালে উনি অনেক ঠাকুর করেছেন। সে যাইহোক, যে কোনও কারণে মনমালিন্য হল, ছেড়ে দিয়ে ষড়ঙ্গীতে চলে এলেন, রাজবল্লভ পাড়ার ওখানে। সেখানেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এবং তিনি নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতেন। অনেকক্ষন দেখতেন। অনেকক্ষন ভাবতেন। যেখানে প্রয়োজন মনে হত কেটে ফেলে আবার সেটাকে তৈরি করতেন। কলকাতার পুজো নিয়ে অশোক-দা’র যে চিন্তাভাবনা সেটা আমার মধ্যে ফ্লো করেছে। শেষেরদিকে সনাতন দিন্দা’র মধ্যেও ফ্লো করেছে, সুব্রত গাঙ্গুলীর মধ্যেও ফ্লো করেছে। সাধারণ মানুষ অবশ্য সেটাকে মেনে নেয়নি। তখন সেটাকে আর্টের ঠাকুর বলা হত। অসামান্য দক্ষতায় দুদিনে লক্ষ্মী ঠাকুর বাঁধতেন। সেই লক্ষ্মী যেন এক পরিপূর্ণ লক্ষ্মী। তার আঁকা রং যেন আমার চোখে এখনও ভাসে। আমি অশোকদা’র কাজের ধরন অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম।

Share