ভাস্করের চোখে/৭

বিচারের ক্ষেত্রে সমঝোতা নয়

বিমল কুন্ডু

আর্ট কলেজের ১০০ জন ছেলে-মেয়ের মধ্যে কাউন্সিলিং এর জন্য আমাকে এবং সুব্রতকে নিয়ে যাওয়া হত। আমরা কারও কথা না শুনে যে ভাবে
বিচার করেছি, সেইভাবেই কাউন্সিলিং করেছি। বিচারের ক্ষেত্রে আমি কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন কম্প্রোমাইজ করিনি। আজ পর্যন্ত আমার কাছে কেউ ‘আমাকে একটু দেখো’-এই অনুরোধ কেউ করেনি। গিয়েছি, পরিষ্কার দেখেছি ,নম্বর দিয়েছি ,পুরস্কার দিয়েছি । একটা কথা হচ্ছে এমন অনেক কিছু জিনিস আছে যারা এই সেলিব্রিটি সিনেমা আর্টিস্ট , ফ্লিমস্টার এরা বুঝতে পারবে না।
এই মিডিয়াম টা কি, কি করেছে, কতটা করেছে, কেন করেছে, কতটা সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছে তা ওদের বোধগম্য হয় না। আমি ওভারঅল দেখলাম , মনে করলাম যে খুব সুন্দর। আমাকে একটা রসগোল্লা খেলাম এবং সেই রসগোল্লার মধ্যে যে কতটা পরিশ্রম লুকিয়ে আছে, সেটাকে তোমাকে বুঝতে হবে। আমি এগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি। সেখানে আমাকে কেউ ডমিনেটও করত না, আমিও পরিষ্কার কথা বলতাম যে এটা এমন ভাবে করতে পারতে।
শেষ দু বছর ধরে মণ্ডপে যেতে না পারলেও আনন্দবাজারের হয়ে অনলাইনে অফিসে বসে যখন দেখছি, আমাদের কথা অনুযায়ী ওদের প্রত্যেকটা ক্যামেরাম্যান ক্যামেরাটা ধরছে এবং আমরা এইভাবে কমপ্লিটলি ক্লোজ দেখতে পাচ্ছি।
আমি যত জায়গায় গেছি তা কোন সমস্যা হয়নি আর অসলটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি, কোনটা ঠিক , তার পরিবেশগত তার মান, তার প্রতিমা, তোর চেহারা , সবদিক দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি।
বেসিক্যালি , বাঃ….! আমি যখন ঢুকছি , মুখ দিয়ে এটা বেরিয়ে যেত।
আমি কখনওই মনে করিনা , সিনেমা আর্টিস্ট থেকে শুরু করে, থেকে নাটকের আর্টিস্ট থেকে, গানের আটিস থেকে শুরু করে সাহিত্যিক থেকে শুরু করে সবার মধ্যে সেই কোয়ালিটি আছে। একটা কোয়ালিটি আছে বলেই নাচে-গানে সেই জায়গায় পৌঁছেছে, সেই মানুষটি যখন দেখছে, তারও একটা সেই রুচি বোধ থেকে দেখছে। আমি বিমল কুন্ডু জাজ করছি , ও জাজ নয়, তা নয়।
আমি একটা ছোট্ট ঘটনা বলছি। একবার ইটিভির সঙ্গে জাজমেন্ট করতে যাচ্ছি। আমার গাড়িতে আমি আর চুনী গোস্বামী। চালতাবাগানে ঢুকেছি , চুনি বলল, ‘আমি নামবো না, তুমি দেখে এসো। আমি অত বুঝি না। যা বলবে ,আমি নম্বর দিয়ে দেবো।’ আমি বললাম, ‘আপনি নামুন , গিয়ে দেখুন। ঠাকুরটা দেখুন। আর আপনার যেটা মনে হবে একটা নম্বর দেবেন। আমি আমার নম্বর দেব আপনার সিটে , তারপর যদি মনে হয় আপনারটা ঠিক হয়ে গেছে তখন আমি দেখব। কি আশ্চর্য, আমি দেখে আসার পর উনি যখন নম্বর দিলেন। আর আমি যখন দিলাম সেটা এক। তখন একটা কথা মনে হলো যে চুনি দা একজন মাঠের শিল্পী, তিনি যখন গোল করছেন মাঠে খেলছেন তার একটা নিজস্ব রুচিবোধ বা জায়গা তৈরি হয়েছে। সে তার বিচার বুদ্ধিতে নাম্বারটা দিলো। আমি তো খেলা দেখি না , খেলা বুঝিনা কিন্তু মাঠে প্লেয়ার কাটিয়ে নিয়ে একটা গোল দিচ্ছে, এটা তো বুঝি আমি । তা ক্ষমতাটা বুঝি, তাকে তো বলব ফাস্ট ক্লাস প্লেযার। ঠিক ওনার ক্ষেত্রেও তাই। এবং পরবর্তীকালে যখন গানের শিল্পী আর্ট শিল্পী বা অন্যান্য শিল্পীরা যখন জাজ করেছেন তারা কোন অংশে কম নয়, কিন্তু অনেকেই বলে আপনি শিল্পী আপনি অনেক জানেন, ভাল বোঝেন, কিন্তু রাইমা কি বোঝেন? ঋতুপর্ণ ঘোষ কি বোঝেন? সে তার শিল্পের ক্ষেত্রে কোন জায়গায় পৌঁছেছে বলে তো তাকেই সম্মানটা দেওয়া হচ্ছে, তার যে চোখ বাবদ কিছুই নেই এটা বললে ভুল হবে, তারা আমার থেকে কিছু কম নয়। ওভারঅল সে বুঝতে পারছে, ভালোলাগাটা বুঝতে পারছে। আমার কথাটা হচ্ছে কি , যে ভালো লাগাটা আমার লাগবে বাড়ির কাজের মহিলা সেটা ভালো লাগবে।
আমি যদি ভেবে থাকি যে, অমুক বলেছে পুরস্কার দিতে হবে, সেটা আলাদা ব্যাপার।
আমি আর একটা ঘটনা বলছি , ভব সে বার ঠাকুর করেছিল পাতিপুকুরে প্রদীপ সংঘে। আমরা ও সারদা লক্ষী সেই যাদবপুর থেকে দেখছি এরকম সব ট্রেডিশনাল ঠাকুর, দেখছি সবার চোখ দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে , তখন আমি বলছি ঠিক আছে ! দাঁড়াও দাঁড়াও ধরো আরো দেখতে পাবে, আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে পেন্সিলে নম্বর দাও। এই করতে করতে রাত দশটার প্রদীপ সংঘে যখন ঢুকলাম (মিউজিক তো আপনা আপনি বাজছে) স্বাগতা লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান গাইতে করতে শুরু করে দিল, শ্লোক গাইতে শুরু করে দিল। এবং বেরিয়ে কোনও কথা নয় যার যার সিট গুলো জমা দিয়ে দিল, নম্বর দিয়ে। এই যে আমার অভিজ্ঞতা হল কি যারা আমার সাথে যায় বিচারক হিসাবে সিনেমাটিক কালার আর্টিস্ট নাটক আটিস্ট সে যাই হোক না কেন তাদের নিজস্ব রুচিবোধ থাকে ,তাদের নিজস্ব ভাবনা চিন্তা থাকে, তার নিজস্ব বক্তব্য থাকে।
আমিতো অনেক সময় যাদের সঙ্গে গেছি তারা তো কখনও ইনফ্লুয়েন্স করেনি আমাকে। তারা কখনও বলেনি যে এটা এইভাবে করো ওই ভাবে কর। বলার কোনো অবকাশ থাকে না, ভালোটা তো ভালোই। ভবর ঠাকুর দেখতে গেছি ভালোটা তো ভালই।। এমন অনেক কাজ দেখেছি , শেষবার আমার সঙ্গে যখন অরিন্দম শীল ছিলেন সেখানেও ঠিক একই রকম। সল্টলেকে প্রেসক্লাবের হয়ে, নাগরিক সাম্যবাদের হয়ে আমি প্রায় ১০ বছর কাজ করেছি, সে আরও পরিশ্রম , আনন্দবাজারে তো ছ’খানা দেখতে হয়। এমন অনেক কাজ করেছি , চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছি সাথে অনেক সম্মান পেয়েছি। শুধু তাই নয়, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী ঠাকুর করেছি, সঙ্গে ছিল লকেট , রুদ্রনীল। লকেট বেশ কয়েকবার আমার সাথে গেছে। এমন অনেক ক’বার জগদ্ধাত্রী পুজা করেছি আনন্দবাজার এর হয়ে।
এই যে কলকাতা কর্পোরেশন, একটা গোলটেবিলে সেলিব্রিটি বসিয়ে দিলাম, প্যান্ডেলের ঠাকুর আছে কি? ২০০ ঠাকুর তুলে নিয়ে আসছে। কোনও কোনও প্যান্ডেলের ঠাকুর নেই। সেটাও তুলে নিয়ে এসেছে। আমরা দেখে দেখে নাম্বার দিয়েছি। কি বুঝছি ?
কিন্তু আনন্দবাজার গ্রুপ যে কাজ করে তাদের কোনও তুলনা হবে না, যখন আমরা যাই, তাদের ১০০ ইভেন্টের লোক থাকে, আমাদের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয় না। একেবারে ঘিরে ফেলে। আমি যখন অরূপের ওখানে গিয়েছিলাম লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে দড়ি ফেলে দিয়েছিল আমার দেখে লজ্জাও লেগেছিল।

Share