উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে
দীপক ঘোষ
২০০৫ সালের এপ্রিল মাসের কাছাকাছি প্রদীপ রুদ্রপাল আমাকে ফোন করে বলে ‘দীপকদা চক্রবেরিয়া ত্রিকোণ পার্ক এর এ বছরে হীরক জয়ন্তী, আমি ওদের ঠাকুর বানাই। আমার কাছে ভালো কাজ করারও শিল্পী চাইছিল আমি না তোমার নামটাই রেফার করেছি, আর তোমার ফোন নাম্বারটা ওদের দিয়েছি। তুমি না কোরো না প্লিজ।’ আমি এতদিন একটা করে কাজ করেছি, সম্মান পেয়েছি প্রচুর, সঙ্গে প্রয়োজনীয় পারিশ্রমিক। ওই যে বলেছিলাম যেদিন ছাত্রের বুকপকেটে সিগারেটের প্যাকেট দেখতে পাই সেদিনই সকলকে জানিয়ে দিয়েছিলাম কাল থেকে আমি আর পড়াবো না। তখন থেকে আমাকে অর্থ উপার্জনের দিকটাও দেখতে হতো অন্য সব ব্যবসায়ীদের মত লোকের কাছে কাজ চাইতে পারতাম না বলে। সেই সময় বাজারে computer বেশ সস্তা হয়ে যাওয়ায় আমার কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ইউনিট ঢিমেতালে চলছিল। তাই ভাবি যদি আর একটা এক্সট্রা কাজ করি তাহলে তো হাতে অতিরিক্ত অর্থ আসে। সেই জন্যই প্রদীপের কথায় রাজি হয়ে ওদের আসতে বলি। একদিন চক্রবেরিয়া ত্রিকোন পার্ক থেকে শিবাদিত্য, চন্দন ও গোড়া আমার ওয়ার্কশপে আসে। আমি জিজ্ঞাসা করি তারা তাদের হীরক জয়ন্তী তে মণ্ডপের জন্য কত খরচা করতে রাজি আছে সেই বুঝে আমি আমার পরিকল্পনা জানাবো। ওরা চলে যাওয়ার পর থেকেই আমার মাথায় আসে ডায়মন্ড জুবিলিতে হীরের কাজ করলে কেমন হবে? প্রতিদিনই ভাবি আরো উপায় খুঁজে পাই না। এটাও বলে রাখি আমার নিজে থেকে দাড়ি কাটায় একটা এলার্জি আছে তাই সপ্তাহে অন্তত দুবার সেলুনে গিয়ে দাড়ি কাটি। সত্যি কথা বলতে কি সে সময় নামজাদা সেলুনে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না তাই পাড়ার ছোট দোকানেই দাড়ি কাটতাম। একদিন দাড়ি কাটার জন্য সেলুনে গেছি দাড়ি কাটার লোক কম থাকায় আয়নার সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। একজনের কাটা হয়ে গেলে সেই ক্ষৌরকার আমার দাড়ি টা কাটবে । হঠাৎ আমার চোখে পড়ল একডালা ফিটকিরি চকচক করছে আর তাতে আলো পড়ে আলোর ছটা ছিটকে পড়ছে অনেকটা হীরের দ্যুতির মত। ওটা দিয়েই সম্ভবত সকলের দাড়ি কাটার পর এন্টিসেপটিক হিসেবে ওই ফিটকিরি ব্যবহার করা হয়। আমি সেলুনের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমরা এই ফিটকিরি কোথা থেকে কেন? উত্তরে বলল দাদা এটা সেলুনের জন্য, আপনি আপনার ব্যবহারের জন্য সাবান এর মতন দেখতে ফিটকিরি ব্যবহার করতে পারেন – বলে একটা সাবানের মতো ফিটকিরি দেখালো। আমি দেখলাম দুটো ফিটকিরিতে বিস্তর তফাৎ। সাবানের মধ্যে Opacity বেশী আর অন্যটা crystal clear। ওই সেলুন থেকে একটা বড় ডেলার ফিটকিরি কিনে আনলাম, সঙ্গে কয়েকটা নুরুন। আমার দলের এক সহশিল্পী বলল ‘দাদা পিন্টু মোল্লা নামে একটা ছেলে আছে ও খুব ভালো চকে কার্ভিং করে। বর্তমানে একটা জেরক্সের দোকানে কাজ করে।’ সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলাম,’এক্ষুনি ওকে নিয়ে আয়।’ পিন্টু পরের দিন সকালে আমার কাছে এলো। কয়েকটা চকের ওপর খোদাই করা স্থাপত্য নিয়ে। সবকটাই অনবদ্য! আমার ওয়ার্কশপের পরিবেশ দেখে ও রাজি হল আমার সঙ্গে কাজ করার জন্য। মাস মাইনের চুক্তিতে। তখন আমি ওকে সেই ফিটকিরির ডেলাটা দিয়ে বললাম তোমার মত করে কোন মডেল কেটে দেখাতে পারবে? সঙ্গে সেই নুরুনগুলো দিয়ে দিলাম। দুদিন পরে আমার কাছে নিয়ে আসলো একটা স্বরস্বতীর মডেল যা ওই ফটকিরি কেটে তৈরি করা। আমি তাকে খুব ভালো করে জল ঘষে অনেকটা মসৃণ করলাম, তারপর পেছন থেকে টর্চ মেরে দেখলাম পুরো জিনিসটাই একটা হীরের মতন জ্বলজ্বল করছে। আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই শিবাদিত্য- চন্দন দের ডেকে পাঠালাম বললাম ফিটকিরি দিয়ে আমি হীরের মন্ডপ বানাবো ভেতরে আলো দিয়ে যা তোমাদের ডায়মন্ড জুবিলি সঙ্গে মানানসই হবে। মডেলের পেছনে টর্চের আলো দেখে তারা উচ্ছ্বাসে ফেটে পরলো। হ্যাঁ দাদা এটা একদম নতুনত্ব আপনি করুন। আমি যে করব তার রিসার্চ করাটাও তো প্রয়োজন। কিভাবে করব? তার জন্য কিরকম ফিটকিরির প্রয়োজন? সেগুলো কে সেট ভাবে করব কিভাবে? তার বিস্তর রিসার্চ-ওয়ার্ক দরকার। সবচেয়ে বড় কথা হল ফিটকিরির ব্লক আমি কোথায় পাব? কারণ ফিটকিরি সাধারণত তৈরি হয় কতগুলো কেমিক্যাল দিয়ে ঢাকের মতো দেখতে একটা কাঠের ড্রামের মধ্যে। কেমিক্যাল গুলো জমে গেলে তারপর ওই ড্রাম থেকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফিটকিরি বের হয়। ছোট ছোট ফিটকিরি থেকে তো মডেল বানিয়ে নিতে পারব কিন্তু সেটা ফটকিরির slab এর সঙ্গে লাগাবো কিভাবে? এইসব চিন্তা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক করত। বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে শুরু করে এরকম অসংখ্য ইউনিটের যোগাযোগ করলাম কেউ আমাকে ২ ফুট বাই ২ ফুটের ১ ইঞ্চি মোটা ফটকিরির ব্লক বানিয়ে দিতে পারবে কিনা? যখন সমস্ত জায়গা থেকেই হতাশ হয়ে ফিরলাম তখন রানাঘাট অথবা চাকদার (অনেক দিন হয়ে গেছে, তাই জায়গা ও সেই ভদ্রলোকের নামটা মনে আসছে না!) কাছে একটা ফ্যাক্টরির মালিক রাজি হল ২ফুট বাই ২ফুটের এর এক ইঞ্চি থিকনেস ফিটকিরির স্ল্যাব বানিয়ে দেবে। যাই হোক উনি ওনার কথা রাখলেন কিন্তু সময়টা খুব বেশি লাগলো। এরপর মাথায় চিন্তা আসলো ফিটকিরি মডেল গুলো কিভাবে ওই ফিটকিরির slabএ fix করবো? Pedilite, Dendrite ছাড়াও বাজারে প্রচলিত যত রকমের epoxy adhesive পাওয়া যার সব কিছু ব্যবহার করে হতাশ হোলাম। শেষমেশ আগুনের হিট দিয়ে জোড়া লাগানোর চেষ্টা কোরলাম। অবিশ্বাস্য ফটকিরির সঙ্গে ফটকিরি লেগে গেল! হায় বিধি বাম যে, পরের দিন সকালে তা ঝুড়ঝুড় হয়ে খুলে গেল। মাথায় হাত, এবার কি করব? ঠিক করলাম এত বড় রিস্ক নেওয়া উচিৎ হবে না। তাই ওদের ডাকলাম ওদের দেওয়া advance amountটা ফেরৎ নিয়ে যেতে। কারণ এসব ট্রায়াল করতে করতে দেড় মাস কেটে গিয়েছে। আর উচিৎ হবে না। শিবাদিত্যও নাছোড়বান্দা, ‘এটা পারলে একমাত্র তুমিই পারবে। please হাল ছেড়ো না”। বুঝলাম না, এটা গ্যাস, না বিশ্বাস! সেই সময় মুদিয়ালির জন্য থার্মোকলের কাজ হচ্ছিল।যে আমাদের আঠা সাপ্লাই করতো সে লখনউর আঠা কোম্পানির মালিকের (যিনি একজন chemist ও) সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার problemটা solve করে দিলেন customize আঠা supply করে। তবে ঐ chemist এর শর্ত ছিল batch এর ১০০ কিলোগ্রামের পুরোটাই আমাকে নিতে হবে কারণ তা ওরা বাজারে বিক্রি করতে পারবে না (আমার কিন্তু কাজে লেগেছিল মাত্র ৬ কিলোগ্রাম)। যাইহোক কাজ শুরু করার পর আরো কয়েকজন যুক্ত হলো, যার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো অমল পাল। কাজ শুরু করার পর আরো দুটো সমস্যায় পরলাম। ফটকিরির ক্ষার ছেলেদের জামাকাপড় আর ঘরের মেঝে নষ্ট হতে শুরু করল। সঙ্গে সময় মতো ফটকিরির যোগান না মেলা। এটাই বোধহয় আমার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের কাজ। মোট ফটকিরির মাত্র ৪০%(চল্লিশ ভাগ) কাজে লেগেছে আর বাদবাকি পুরোটাই ক্ষতি। যাইহোক iron structure করে তার গায়ে screw দিয়ে ঐ slab গুলো লাগিয়ে ডিজাইন গুলো fix করা হয়েছিল। আমার সঙ্গে illumination designer বিশ্বজ্যোতি জোয়ারদার এর সঙ্গে আলাপ ছিল দিলওয়ারা টেম্পলের সময় থেকে। ক্লাব কর্মকর্তারা ওনাকে appoint করলেন আলোটা করে দেবার জন্য। সঙ্গে দিলেন তাদের নিজস্ব electrician, কে যার কাছে ঐ মণ্ডপে প্রয়োজনীয় বিদেশি lumineers নেই। তখনো আমার সঙ্গে দীনেশদার পরিচয় হয়নি যার কাছে ঐ মন্দিরের প্রয়োজনীয় সমস্ত রকমের আলোর ব্যবস্থা ছিল! কপাল খারাপ তাই আমার visualize করা আলোর দ্যুতি দেখতে পেলাম না প্রথম sampleএর মতো। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, ওই বছরই ওদের মণ্ডপে ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রথম এসেছিল তখন সেটা স্টার আনন্দ ছিল। পুরো পাড়া যেন ভেঙে পড়েছিল ওই মন্ডপ প্রাঙ্গণে ।মোটামুটি একটা উৎসবের চেহারা নিয়ে নিয়েছিল। সেদিনের দুপুরের খাবার কে আমাকে খাওয়াবে তা নিয়ে মোটামুটি টানাটানি শুরু হয়েছিল।
এবার আসি আসল প্রসঙ্গে— আমাদের মণ্ডপ টার real look আনার জন্য লোহার frame ছাড়া বাঁশ-খুঁটি বা ত্রিপল কোনো কিছুই ব্যবহার করা হয়নি। ষষ্ঠী থেকে ওখানে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি (আশ্চর্যের কথা মুদিয়ালিতে বৃষ্টির ছিটে ফোঁটা ও ছিল না)। হঠাৎ ডাক পরলো – ঠাকুরের মাথায় জল পড়ছে! সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠালাম, তখন বৃষ্টি থেমে গেছে তাই তারা কিছুই ধরতে পারলো না। চলে এলো। আবার দুপুর তিনটের সময় অকথ্য ভাষায় ফোন এলো আবার জল পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে ই আমি একজন কে নিয়ে মণ্ডপে যাই। প্রসঙ্গত বলে রাখি ১৯৯৬ সালে এক্সিডেন্টে আমার ডান পা ৬ টুকরো হয়ে গেছিল যার জন্য আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। আর তারপর থেকে কোনও ম্যারাপে উঠতেই পারতাম না।) তা সত্বেও রিস্ক নিয়ে মন্দিরে চূড়ায় উঠি। হায় কপাল! electric তার কম লাগানোর জন্য ওদের electrician এর নির্বোধ সঙ্গীসাথীরা ফটকিরির চূড়া র slab ফুটো করে চূড়া র লাইট লাগিয়ে ছিল তাই বৃষ্টি হলেই ঐ ছিদ্র চুইয়ে দুর্গা র মাথায় জল পড়ছিল আর সেই জন্যই আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে ছিল। আগেই বলেছিলাম সবাই কে ক্ষমা করা যায় না যাদের আচরণ বুকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। এই ২০০৫ সাল থেকেই আমার কাছে পুজো কমিটির ধারণা বদলে গেল। অন্যের দোষে আমার প্রাপ্য টাকার কিছু অংশ তামাদি হয়ে গেল। যদিও বা চুক্তির অর্থের থেকেও আমার অনেক বেশী খরচ হয়েছিল।
মনের দুঃখে ঐ মণ্ডপের কোনও ছবিও রাখিনি।কারণ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই মণ্ডপ আমাকে কাঁদিয়েছে। কয়েক জনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছি, কারণ তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিল।