যাদব সেন
২৬২ বছর ধরে পুজো হয়ে আসছে নদিয়ার শান্তিপুরের বাইগাছিপাড়ার সেনবাড়িতে।
সেনবাড়ির পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল শান্তিপুর অঞ্চলের কাছেই ‘হরিপুর ব্রহ্মশাসন’ নামক এক অঞ্চলে, সেখানেই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল ১৭৫৮ সালে, শুরু করেছিলেন কৃষ্ণকুমার সেন। পলাশীর যুদ্ধের পরের বছরই সেনবাটীতে দুর্গার আরাধনা শুরু হল কেন, তা ব্যাখ্যা করে সেনবাড়ির বর্তমান সদস্য শ্রী জয়নারায়ণ সেন জানালেন, পলাশীর যুদ্ধের সময়ে বাংলার নবাবকে নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন। এরপরই দুর্গাপুজোর সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে গৃহবন্দী করেছিল। সেই দুঃখে সেনবাড়ির সপ্তমপুরুষ পুজো শুরু করলেন সেনবাটীতে। হরিপুরে থাকাকালীন ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপে সেনবাড়ির পূর্বপুরুষেরা চলে আসেন শান্তিপুরের মতিগঞ্জ নামক অঞ্চলে। সেখানেও পুজো চলে ধারাবাহিকভাবে, আনুমানিক ১৮৮০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু পরপর পাঁচ বছর বন্যার কারণে পুজো বন্ধ হয় এবং সেই অঞ্চল থেকে সেনবাড়ির সদস্য, শ্রী মাধবচন্দ্র সেনের পুত্র শ্রী রামগোপাল সেন চলে আসেন এই বাইগাছিপাড়ায়। রামগোপাল সেন শান্তিপুরের অদ্বৈতবংশের কোনও এক পুরুষের থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধারায় দীক্ষিত ছিলেন।
বাইগাছিতে এসে রামগোপাল সেনের স্ত্রী মতিসুন্দরী দেবী পুজোর আগে এক মৃন্ময়ী দুর্গাবিগ্রহ নিয়ে আসেন। সেই থেকে আবার পুজো শুরু হয়ে যায় সেনবাড়িতে। রথযাত্রার দিন কাঠামোপুজোর মাধ্যমে এই বাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। তারপর মৃন্ময়ীপ্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। এই বাড়ির দুর্গা স্বর্ণবর্ণা এবং একচালচিত্রের এই প্রতিমায় ডাকের সাজ দেখা যায়।
সেনবাড়ির দুর্গাপুজো হয় ‘দেবপুরাণ’ মতে। ষষ্ঠ্যাদিকল্পারম্ভে পুজোর শুরু। এই বাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ষষ্ঠীর দিন বিকালেই নবপত্রিকার স্নানপর্ব হয় এবং সপ্তমীর দিন ঘটপ্রতিষ্ঠা ও মূল বিগ্রহে পূজা শুরু হয়। এই বাড়িতে সম্পূর্ণ নিরামিষ অন্নভোগের প্রচলন রয়েছে। যেমন— খিচুড়িভোগ, পোলাও, লুচি, পাঁচরকম ভাজা, নানারকম তরকারি, মিষ্টান্ন, পায়েস, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি নিবেদন করা হয় এবং দশমীর দিন ফলমিষ্টিভোগ ও দধিকর্মা নিবেদন করা হয় দেবীকে। দুর্গাপুজোর মহানবমীতে এই পরিবারে চালকুমড়ো এবং আঁখ বলিদানের প্রথা রয়েছে। এছাড়া মহানবমীতিথিতে ধুনো পোড়ানোর রীতিও রয়েছে সেন বাড়িতে। দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীর দিন হয় কুমারীপুজো, এবং সন্ধিপূজাতে ১০৮ দীপদান হয়। দশমীর দিন দেবীবরণের পর কনকাঞ্জলিপ্রথাও রয়েছে সেনবাড়িতে। উমা আবার শ্বশুরঘরে যাচ্ছেন, তাই কনকাঞ্জলি দিয়ে বাড়ির মেয়েকে বিদায় জানানো হয় এবছরের মতো। অতীতে কাঁধে করে দেবীর বিসর্জন হলেও বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ। এইভাবেই বহু বছরের এই পুজো আজও নিষ্ঠার সাথে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে এবছর করোনা ভাইরাসের কারণে সাধারণ দর্শকের জন্য ঠাকুরদালানে দেবীদর্শন বন্ধ থাকতে পারে বলেই জানালেন পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য শ্রী জয়নারায়ণ সেন মহাশয়।