শিল্পীর পুজোনামচা/২

পাড়ার শিল্পী থেকে থিম শিল্পী

দীপক ঘোষ

খুঁটি পুজো দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম কারণ খুঁটি পুজো দুর্গাপূজার সূচনা করে। এবার আসি দুর্গাপুজোর সম্বন্ধে আমার অতীত ও বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি কি তা শেয়ার করার জন্য।
ছেলেবেলার মন ভীষণভাবে রঙিন, তাতে যতখুশি রঙের প্রলেপ দাও না কেন এর অন্ত নেই, কারণ সেই মন ছিল সম্পূর্ণ নিষ্পাপ এবং দায়িত্ব বিহীন তাই পুজোর চার দিন লেখাপড়াকে সিঁকেয় তুলে যথেচ্ছ আনন্দে মেতে থাকতাম। কিন্তু যেই কৈশোরে পা দিলাম তখন পুজোর আঙিনায় সরাসরি যুক্ত হলাম।  আঁকাআকি করার সুবাদে আমার একটু পরিচিতি ছিল বলে পাড়ার পুজোর মণ্ডপ সজ্জার দায়িত্ব আমার কাঁধে বর্তাতো। এইভাবে পাড়ার পুজো মণ্ডপ সাজাতে সাজাতে সেই পাড়ার পুজোর মূল কান্ডারী হয়ে পুজোর সম্পূর্ণ দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত করলাম । ওই দায়িত্ব পালনে টেনশন থাকলেও অন্যান্য দুশ্চিন্তা থাকত না কারণ ছোট পুজোর খোরাক যে নিতান্তই ছোট। ২০০১ সাল থেকে পাড়ার পুজো থেকে বেরিয়ে শিল্পীর দলে নাম লেখালাম আমার এক পরিচিতের অনুরোধে। সেই সময় যোধপুর পার্কে ‘বাওয়ালি মন্ডলের রাজবাড়ির’ আদলে পড়ন্ত জমিদার বাড়ির খুব টেনেটুনে দুর্গাপূজা করার ছবিটা তুলে ধরেছিলাম। প্রচুর সুনাম পেয়েছিলাম তবে ‘ভাঁড়ের  মন্ডপ’ আমার প্রথম কাজটাকে অতোটা পুরস্কার নিতে দেয়নি! সেই সময় অবশ্য পুরস্কারের জন্য পুজো কমিটির এত চাহিদা ছিল না। কিন্তু ২০০২ সালে ওই যোধপুর পার্কে ‘দিলওয়ারা টেম্পল’ বানিয়ে সকলের নজরে পড়ে গিয়েছিলাম।বিশেষ করে আনন্দ বাজার পত্রিকার-  শ্রী সুমন চট্টপাধ্যায়ের, শ্রী দেবদূত ঘোষ ঠাকুর ও শ্রী অশোক মজুমদারের। ওনাদের রিপোর্টিংয়ের জন্যই সেই দিন থেকেই অন্যান্য সব প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া আমার ওই কাজটা নিয়ে খুবই মাতামাতি করেছিল ফলে পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে আমি খুব গণ্যমান্য হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু আমি নিজের পরিমাপ জানতাম বলে কখনোই নিজেকে ‘শিল্পী’ হিসেবে দাবী করিনি। কারণ আমাদের কাজের ৯০% আমরা পরনির্ভরশীল তাই ওই ১০% নিয়ে অহম ভাব করাটা নিতান্তই মূর্খামো, আমাদের কাজটা যে একটা টিম ওয়ার্ক। ছয় সাত মাস একটানা পুজোর কাজ করার ফলে শরীর এতটাই কাহিল হতো যে তৎকালীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের (যাদের আপনারা পুজোর ট্রেন্ডসেটার বলতে পারেন) শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। যাই হোক কিছুকাল যাবার পরে দুর্গা পুজো কে নিয়ে ভীষণভাবে নাড়াচাড়া করা অন্য আর এক ব্যক্তিত্বর (যার নাম সম্রাট চট্টোপাধ্যায়) এক অভিনব প্রয়াস “সপ্তরথী মহারথী”র সৌজন্যে বেশকিছু স্বনামধন্য শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। প্রত্যেকেই ভালো মাপের শিল্পী কিন্তু ভিশন প্রফেশনাল! মানে সুযোগ পেয়েছি, সূচাগ্র মেদিনীও দেব না (অর্থাৎ যথেচ্ছ নাম্বার দেব না) ওই ক্ষেত্রেই আমি ছিলাম ব্যতিক্রমী। যাই হোক আমার সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা তখন কিন্তু পুজো মণ্ডপ সাজাতেই ব্যস্ত থাকতো, ‘নিজেকে’ নয়।
পুজোতে শিল্পীদের কাছে একটি শব্দ ‘অনুসরণ’ খুব রক্ষণশীল ভূমিকা নিতো। আপনারা সকলেই জানেন আমি সাধারণত স্থাপত্য নিয়ে কাজ করতে ভালবাসি সেটা সম্পূর্ণ ‘অনুকরণ’ কৃত। কিন্তু আমি অনুকরণ করেছি সেই সমস্ত কঠিন স্থাপত্যকে- যেটা খুব সহজ কাজ নয় এবং যা কখনো কর্মকর্তাকে আশাহত করেনি।
যাই হোক যত দিন যেতে লাগল দুর্গাপূজা আস্তে আস্তে “দুর্গা উৎসবে” পরিণত হয়ে গেল আর তখন থেকেই এটা একটা বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ালো ফলে পাড়ার পুজো গিয়ে দাঁড়ালো আক্ষরিক অর্থে “সমগ্র ভারতের সার্বজনীন উৎসব”, যেখানে বৈভব থাকলেও আত্মিকতা নেই। সব সময় নিজেকে তুলে ধরার ও সেখান থেকে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। ইন্টারনেটের সুবিধা এসে যাওয়ায় প্রায়  অধিকাংশই ‘অনুসরণ’ শব্দটিকে ঢাল হিসাবে সামনে এনে ‘পুজোর শিল্পী’ সাজতে লাগলো। এতে পুরোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও বাদ গেল না! শরীরে চড়তে লাগলো গয়নাগাটি-পাগড়ি-ওড়না ও ঝুঁটি বাঁধা বড় চুল! এগুলো না থাকলে যেন ওনারা যে শিল্পী তা কেউ বুঝতেই পারবে না। যারা প্রকৃত শিল্পী তাদেরকে এই ‘বেশ’ মানালেও অন্যান্যদের ক্ষেত্রে আমার মতে এটা ‘ছদ্মবেশ’ সহজ-সরল পুজো কর্মকর্তা ধরার ফাঁদ! ও, এ কথাটাও সত্য -“ওনারা ও কম যান না”। এই ছদ্মবেশী শিল্পীরাই এনাদের যথার্থ প্রত্যুত্তর।
এখন আর শারদ প্রতিযোগিতার মান নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি না। আমার শিল্পকর্ম সব পুরস্কার পেলেও ‘এশিয়ান পেইন্ট শারদ সম্মান’ না পাওয়ার মূল কারণ – ‘আমার কাজ অনুকরণ কৃত’ যেটা স্পষ্টতই তাদের নিয়মাবলীতে উল্লেখ থাকে।
পরিশেষে বলি, করোনা আমাদের অনেক প্রিয়জনকে নিয়ে গেলেও পুরনো পুজোকে আবার পাড়ার লোকজনের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে যেখানে পুজোটাই প্রধান, বৈভব প্রায় নেই বললেই চলে। এটাই এক বিরাট পাওনা আমার কাছে এই অবসরের মুহূর্তে।(চলবে)

Share